সুপ্রিম কোর্টের যুগান্তকারী আদেশ
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ অক্টোবর ২০২৪, ১২:৩০:৫০ অপরাহ্ন
বিচারপতি অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনর্বহালের যুগান্তকারী আদেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমদের নেতৃত্বাধীন ৬ সদস্যের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ গতকাল এই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠিত হয় প্রধান বিচারপতি ও পরবর্তী সিনিয়র দু’জন বিচারপতিকে নিয়ে। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনর্বহালের ফলে দেশের বিচার ব্যবস্থার হারানো গৌরব ও ঐতিহ্য ফিরে আসার পাশাপাশি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ফিরে পাবার পথ প্রশস্ত হয়েছে, এমন অভিমত অভিজ্ঞ সচেতন মহলের।
বলা বাহুল্য, স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার শাসনামলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অসদাচরণ তদন্ত ও অপসারণের সুপারিশ করার ক্ষমতা জাতীয় সংসদের কাছে দিতে সংবিধানে ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়। এর বৈধতা নিয়ে রীট আবেদন করা হলে রীট আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত বছরের ৫ মে হাইকোর্টের ৩ জন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগের ৭ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ ২০১৭ সালের ৩ জুলাই সর্বসম্মতিতে আপিল খারিজ করে দেন। এর ৪ সপ্তাহ পর সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এরপরও রাষ্ট্রপক্ষ হাল ছাড়েনি। তারা রিভিউ চেয়ে আবেদন করে। এরপর গতকাল এক আদেশে আপিল বিভাগের রায় পুনর্বহাল করেছেন সর্বোচ্চ আদালত।
লক্ষণীয় যে, স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার দেশে সব ক’টি প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণের মাধ্যমে প্রায় ধ্বংস করে ফেলে গত সাড়ের ১৫ বছরের শাসনামলে। দেশের জনগণের ন্যায়বিচার তথা আশ্রয়ের শেষ ভরসার জায়গা হাইকোর্ট ও সুপ্রিমকোর্টও রেহাই পায়নি তার দুরাচারী কর্মকান্ড ও পদক্ষেপ থেকে। বিচার বিভাগের শৃংখলা ও রীতিনীতি লংঘন করে বিচারক নিয়োগ, যোগ্যতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার পরিবর্তে রাজনৈতিক বিবেচনায় বিচারপতিদের নিয়োগ এমনকি তাদের অপসারণের বিষয়টিও কুক্ষীগত করে নেয় তারা। এভাবে বিচার বিভাগ হয়ে পড়ে প্রশাসনের একটি অংশ। তার নিজস্ব এখতিয়ার বা ক্ষমতা বলতে কিছুই অবশিষ্ট থাকেনি। অথচ একটি দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা।
বিচারকরা প্রয়োজনে দেশ ও জনগণের স্বার্থে সংবিধান পর্যন্ত সংশোধন করতে পারেন। এর কোন ধারার কার্যকারিতা স্থগিত কিংবা বাতিল করতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রতিটি উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে বিচারকদের হাতে এমন ক্ষমতা দিয়েছে জনগণ ও রাষ্ট্র। ফলে সরকার কিংবা অন্য কোন শক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে জনগণের স্বার্থ ও অধিকার হরণ করা সম্ভব নয় বিচার বিভাগকে ডিঙিয়ে। এভাবে এসব দেশে বিচারক ও বিচারালয়গুলো হয়ে ওঠেছে সেসব দেশের জনগণের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় ও সুরক্ষার চাবিকাটি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার সরকার জনগণের এই সর্বশেষ হাতিয়ার ও সুরক্ষার চাবিকাটি হরণের সকল ব্যবস্থা করে।
বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ কুক্ষীগত করে বিচারকদের হুকুমের দাস করার লক্ষ্যে তারা সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অসদাচরণ তদন্ত ও অপসারণের সুপারিশ করার ক্ষমতা জাতীয় সংসদের কাছে নিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট এই চরম অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত রুখে দিয়েছে। শেখ হাসিনা সরকার এখনো বহাল থাকলে আপিল বিভাগের রায়ের রিভিউয়ের ফল কী হতো তা বলা মুশকিল। কারণ অবৈধ ক্ষমতার বলে হাসিনা যখন গোটা দেশ ও জাতিকে গোলাম বানিয়ে ফেলেছিলো, সেক্ষেত্রে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতাও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাত থেকে তাদের অবৈধ ক্রীড়নক সংসদের হাতে নিয়ে যাওয়া তেমন কোন কঠিন কাজ ছিলো না। আগের প্রধান বিচারপতি বহাল থাকলে শেষ পর্যন্ত এ সংক্রান্ত বর্তমান আদেশ না হওয়ারই সমূহ আশংকা ছিলো, এমন অভিমত সচেতন মহলের।