বছরজুড়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ: ‘অ্যাক্সপান্ডেড সিনড্রোমে’ বাড়ছে মুত্যুহার
প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২:১১:২০ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : এবারো ডেঙ্গুর প্রকোপ চলছে বছরজুড়ে। প্রতিদিন বাড়ছে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগী এবং মৃত্যুর সংখ্যা। সিলেটে ডেঙ্গুর ঢেউ বেশি না এলেও ঢাকা-চট্টগ্রামের অবস্থা ভয়াবহ। এবার ‘অ্যাক্সপান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোমে’ মৃত্যুহার বাড়ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ২০০০ সাল থেকে দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হয়েছে। দীর্ঘ দুই যুগেও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে জাতীয় কোনো পরিকল্পনা গড়ে ওঠেনি। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং নাগরিকদের সমন্বয়ে সমন্বিত জাতীয় পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি। সকলের সমন্বিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে সামনের দিনগুলোতে বড় ধরনের বিপর্যয় হতে পারে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি বছরের গতকাল অর্থাৎ ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ৯০ হাজার ৭৯৪ জন এবং মোট মৃত্যুবরণ করেছেন ৪৮৫ জন। আর শুধু চলতি নভেম্বর মাসের ২৯ দিনে মৃত্যু হয়েছে ১৭০ জনের।
সাধারণত দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বর্ষার আগে শুরু হয়। মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়কে ডেঙ্গুর মৌসুম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে গত কয়েক বছর ধরে সারা বছরই কম-বেশি ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ডেঙ্গু ভাইরাস বাহিত মশা শীত-গ্রীষ্ম মানছে না, সারা বছরব্যাপী প্রজনন এবং বংশবিস্তার করছে। পাশাপাশি মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর সমন্বিত জাতীয় উদ্যোগ না থাকার ফলে দেশে বছরব্যাপী ডেঙ্গু সংক্রমণ চলছে।
অতীতের বছরগুলোতে শহরের বাসা বাড়িতে আবাসিক ধরনের মশা (এডিস ইজিপটাই) ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটালেও, বর্তমানে গ্রামাঞ্চলের বুনো মশাও (এডিস এলবোপিকটাস) ডেঙ্গুর বাহক হিসেবে কাজ করছে। গত কয়েক বছর ধরে অব্যাহতভাবে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটলেও যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ না করায় ডেঙ্গু ভয়াবহ হয়ে উঠেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরে জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৫৫ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ১৬ জনের, ফেব্রুয়ারিতে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৩৯ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ৫ জনের, মার্চ মাসে আক্রান্ত হয়েছে ৩১১ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ৬ জনের, এপ্রিলে আক্রান্ত হয়েছেন ৫০৪ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ২ জনের।
মে মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ৬৪৪ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের, জুন মাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৭৯৮ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ৮ জনের, জুলাই মাসে আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ২৬৯ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ১৪ জনের, আগস্ট মাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৬ হাজার ৫২১ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ২৭ জনের। সেপ্টেম্বর মাসে ১৮ হাজার ৯৭ জন আক্রান্ত হয়েছেন এবং ৮৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। অক্টোবর মাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৩০ হাজার ৮৭৯ জন, মারা গেছেন ১৩৫ জন। নভেম্বর মাসের গতকাল অর্থাৎ ২৯ তারিখ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ২৮ হাজার ৯৭৭ জন, মারা গেছেন ১৭০ জন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসেও মোটামুটি ডেঙ্গুর সংক্রমণ থাকবে। এ বছরের ডেঙ্গুর প্রকোপ আগামী বছরের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত থাকবে। বছরজুড়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ডেঙ্গু বাড়বে এরকম পূর্বাভাস আগে থেকেই ছিল। এবার বর্ষা একটু দেরিতে শুরু হয়েছে তাই ডেঙ্গুর প্রকোপও শুরু হয়েছে দেরিতে। ডেঙ্গু যে হারে বাড়ছে, সেটা বিপজ্জনক। আমরা জানি, যদি এডিস মশা প্রজননের উপযোগী পরিবেশ তৈরি হয় তাহলে ডেঙ্গু বাড়বে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকসাস ডিজিজেস (বিআইটিআইডি) এর মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মামুনুর রশীদ বলেন, ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সঠিক কারণ অনুসন্ধানে গবেষণা জরুরী। তিনি বলেন, বর্তমানে অ্যাক্সপান্ডেন্ট সিনড্রোম ডেঙ্গুর আরেকটি সমস্যা। ডেঙ্গুতে অনেক সময় মারাত্মক কিছু জটিলতা তৈরি হতে পারে। এসব জটিলতায় সাধারণত লিভার, কিডনি, মস্তিষ্ক, হৃৎপি-, ফুসফুস ইত্যাদি অঙ্গ আক্রান্ত হতে পারে। এসব অঙ্গ যখন আক্রান্ত হয় তখন অস্বাভাবিক কিছু লক্ষণ প্রকাশিত হয়। এ জটিলতাগুলোকে ‘অ্যাক্সপান্ডেন্ট ডেঙ্গু সিনড্রোম’ বলছি। থ্যালাসেমিয়ার রোগীরাও এ সমস্যায় পড়ছে। অ্যাক্সপান্ডেন্ট ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার বাড়ছে।
কেন ‘অ্যাক্সপান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোমে রোগীর মৃত্যু বেশি হচ্ছে এমন প্রশ্নে তিনি বলছেন, ডেঙ্গু হওয়ার পর হাসপাতালে দেরিতে আসা, ডেঙ্গুর পাশাপাশি অন্যান্য রোগে আক্রান্ত থাকার কারণে মৃত্যুঝুঁকি বেশি দেখা যায়। তাছাড়া আগে কোনো একটি ডেঙ্গু সেরোটাইপ বা ধরনে আক্রান্ত হলে এবং নতুন করে আরেকটি ধরন বিশেষ করে সেরোটাইপ-২ এ আক্রান্ত হলে ‘অ্যাক্সপান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোমের’ ঝুঁকি বেশি।রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) বর্তমান উপদেষ্টা এবং সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক ডা. মো. মুশতাক হোসেন বলেন, বছরব্যাপী ডেঙ্গুর সংক্রমণের কারণ প্রথমত প্রাকৃতিক, নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেও বৃষ্টি এবং গরম অব্যাহত ছিল। বৃষ্টিপাতের পরেও ডেঙ্গু অন্তত দেড় থেকে দুই মাস থাকবে। শেষ বৃষ্টির পরে পানি জমা থাকা অবস্থায় শেষ যে মশা ডিম পারে, সেই ডিম থেকে পূর্ণ বয়স্ক মশা হয়ে কোনো ডেঙ্গুরোগীকে দংশন করে, ভাইরাস মশার শরীরে ডেভেলপ করে তারপর আবার কোনো মানুষকে দংশন করে ভাইরাসের ডেভেলপ করা, এই পুরো চক্রটি হতে প্রায় দেড় মাস সময় লাগে।
এদিকে, সিলেটে এখনো ডেঙ্গুর বড় কোন ঢেউ না এলেও প্রতিদিনই কেউ না কেউ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। পরশু সিলেট মহানগর বিএনপির সভাপতি (স্থগিত) নাসিম হোসাইনও ডেঙ্গু জ¦রে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। আবার অনেকেই হিসেবের বাইরে রয়ে যাচ্ছেন। তবে নগরীতে ডেঙ্গুর প্রতিরোধে নেই প্রস্তুতি। নগরীর ছড়া, নালা, ড্রেন পরিষ্কারে উদ্যোগ খুবই কম দেখা যাচ্ছে এখন। বিশেষ করে মশক নিধন অভিযান থমকেই আছে সিলেটে। মাঝে মধ্যে লোকদেখানো দুই-একটি অভিযান চালাতে দেখা যায়-যা কার্যকর নয়।
সিলেট নগরের অবস্থান এমন হয়েছে যে, বিকেল নামার আগেই এখন ঝাঁকে ঝাঁকে বাসা-বাড়িতে প্রবেশ করছে মশা। শীতের এ সময়ে ঘরে মশারি টানিয়েও বাস করা দায় হয়ে পড়েছে। প্রায় প্রতিদিনই অনেকে মশা যন্ত্রণার অভিযোগ করছেন। কিন্তু কে শুনবে এ অভিযোগ?