কর-জিডিপি অনুপাতে তলানিতে বাংলাদেশ!
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ মার্চ ২০২৫, ১০:০৮:০৯ অপরাহ্ন
যুদ্ধ বিধ্বস্ত আফগানিস্তানের অবস্থা এর চেয়ে ভালো
জালালাবাদ ডেস্ক : দক্ষিণ এশিয়ায় তো বটেই, গোটা বিশ্বেই বাংলাদেশের কর-জিডিপি হার নি¤œতম পর্যায়ে রয়েছে। বাংলাদেশের এই হার প্রতিবেশী দেশ নেপালের অর্ধেকের চেয়েও কম। এমনকি যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান বা পাকিস্তানের অবস্থাও এদিক থেকে বাংলাদেশের চেয়ে ভালো অবস্থায় রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের চেয়ে কম কর-জিডিপি অনুপাত শুধু দারিদ্র্যপীড়িত বা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোয় রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশের এ পরিস্থিতিকে লজ্জাজনক ও উদ্বেগজনক বলে মনে করেছেন।
এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ঋণের চতুর্থ কিস্তি ছাড় করার আগে চলতি অর্থবছর কর-জিডিপি অনুপাত ০.৬ শতাংশ বাড়ানোর শর্ত দিয়েছিল। তবে তা অর্জন করতে না পারায় চতুর্থ কিস্তি আটকে গেছে।
আইএমএফের গত মাসে প্রকাশিত ডেটাবেজের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশের সরকারের রাজস্ব আয় তথা কর ও মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাত ছিল বিশ্বে চতুর্থ সর্বনি¤œ। এ সময় বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত দাঁড়ায় মাত্র আট দশমিক ২১ শতাংশ। ওই সময় বিশ্বে সবচেয়ে কম কর-জিডিপি অনুপাত ছিল দারিদ্র্যপীড়িত সুদানের। দেশটির কর-জিডিপি অনুপাত দাঁড়ায় মাত্র চার দশমিক ৫৯ শতাংশ।
তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা যুদ্ধবিদ্ধস্ত ইয়েমেনের কর-জিডিপি অনুপাত ছয় দশমিক ০৩ শতাংশ। তৃতীয় সর্বনি¤œ কর-জিডিপি অনুপাত যুদ্ধবিদ্ধস্ত হাইতির। দেশটির কর-জিডিপি অনুপাত সাত দশমিক ৩০। তালিকায় পঞ্চম স্থানে রয়েছে পূর্ব আফ্রিকার দারিদ্র্যপীড়িত দেশ ইপিওপিয়া। দেশটির কর-জিডিপি অনুপাত বাংলাদেশের চেয়ে সামান্য বেশি আট দশমিক ২২ শতাংশ। আর পশ্চিম আফ্রিকার দারিদ্র্যপীড়িত দেশ নাইজেরিয়ার কর-জিডিপি অনুপাত ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ।
আইএমএফের সর্বশেষ প্রকাশিত ডেটাবেজ অনুসারে কর-জিডিপি অনুপাত ১০-এর নিচে রয়েছে এ ছয়টি দেশের। অন্যান্য দেশের কর-জিডিপি অনুপাত ১০-এর বেশি। এর মধ্যে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ নাইজারের কর-জিডিপি অনুপাত ১০ দশমিক ৪৩ শতাংশ, ভেনিজুয়েলার ১০ দশমিক ৮২, পাকিস্তানের ১১ দশমিক ৫২ ও ইরানের ১১ দশমিক ৬২ শতাংশ। বিশ্বের এ ১০টি দেশের কর-জিডিপি অনুপাত বর্তমানে সবচেয়ে কম।
কর-জিডিপি অনুপাত ১২ থেকে ১৫-এর মধ্যে রয়েছে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ। এর মধ্যে গুয়েতেমালার কর-জিডিপি অনুপাত ১২ দশমিক ৪৭ শতাংশ, লেবাননের ১২ দশমিক ৮৮, গিনি-বিসাউয়ের ১৩ দশমিক ৭৪, মাদাগাস্কারের ১২ দশমিক ৭৭, গিনির ১৪ দশমিক ১৯, উগান্ডার ১৪ দশমিক ৩২ ও মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের ১৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
তালিকা বিশ্লেষণে দেখা যায়, কর-জিডিপি অনুপাত ১৫ থেকে ২০-এর মধ্যে রয়েছে ২১টি দেশ। এ অনুপাত ২০ থেকে ৩০-এর মধ্যে রয়েছে ৪২টি দেশের। ইউরোপ ও এশিয়ার উন্নত বিভিন্ন দেশের কর-জিডিপি অনুপাত ৩০-এর বেশি। এদিকে প্রতিবেশী দেশ ভারতের কর-জিডিপি অনুপাত ২০ দশমিক ৮০ শতাংশ, ভুটানের এ হার ২৪ দশমিক ২৫ শতাংশ ও মালদ্বীপের ৩৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে মালদ্বীপের কর-জিডিপি অনুপাত সর্বোচ্চ। তবে নেপাল, আফগানিস্তান ও শ্রীলঙ্কার কর-জিডিপির অনুপাত ডেটাবেজে উল্লেখ করা হয়নি।
এশিয়ার বিভিন্ন দেশের কর-জিডিপি অনুপাতও বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি। এর মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার কর-জিডিপি অনুপাত ১৫ দশমিক ০৪ শতাংশ, মালয়েশিয়ার ১৯ দশমিক ৬২, চীনের ২৬ দশমিক ২৩ ও জাপানের ৩৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ। বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কর-জিডিপি অনুপাত দ্বীপরাষ্ট্র কিরিবাটির। দেশটির এ অনুপাত ১০০ দশমিক ৭২ শতাংশ। দ্বিতীয় স্থানে থাকা কুয়েতের কর-জিডিপি অনুপাত ৭৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ ও তৃতীয় স্থানে থাকা মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের ৬৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
শীর্ষ ১০-এ থাকা অপর দেশগুলোর মধ্যে নরওয়ের কর-জিডিপি অনুপাত ৬২ দশমিক ১১ শতাংশ, ডমিনিকার ৫৯ দশমিক ৫০, মাইক্রোনেশিয়ার ৫৯ দশমিক ৪৩, লেসোথোর ৫৬ দশমিক ১৯, ইউক্রেনের ৫৪ দশমিক ৮১, ফিনল্যান্ডের ৫৩ দশমিক ৯৩ ও ফ্রান্সের ৫১ দশমিক ৫৩ শতাংশ। এছাড়া বেলজিয়াম ও ডেনমার্কের কর-জিডিপি অনুপাত ৫০ দশমিক ১৪ শতাংশ।
এর বাইরে ৪০ থেকে ৫০-এর মধ্যে কর-জিডিপি অনুপাত রয়েছে ১৯টি দেশের এবং ৩০ থেকে ৪০-এর মধ্যে ৩০টি দেশের।
বাংলাদেশের জিডিপির তুলনায় রাজস্ব আহরণের চিত্র হতাশাজনক বলে মনে করেন সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, ‘কর-জিডিপি পরিস্থিতি শুধু লজ্জাজনক নয়, উদ্বেগজনকও। কারণ, উন্নয়নশীল দেশের যে কাতারে আমরা উঠতে যাচ্ছি এবং এজন্য সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো ইত্যাদি খাতে যে পরিমাণ বাড়তি বরাদ্দ দরকার, সংকটের কারণেই সে পরিমাণ অর্থ সরকার বরাদ্দ দিতে পারছে না।’
তিনি আরও বলেন, কর-জিডিপি অনুপাত কম হওয়ার একটি বড় কারণ, বিপুল পরিমাণ ধনীর কাছ থেকে আয়কর না নেয়া। আয়কর দেয়ার যোগ্য অনেক লোক থাকলেও সরকার তাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না বা পৌঁছাতে চাচ্ছে না। এর এক নম্বর কারণ, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। তবে কর-জিডিপি হারের নি¤œতম হারের কারণে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জন করা সহজ হবে না বলে উল্লেখ করেন তিনি।
প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের ১৩ জুন জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপনের সময় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতি প্রকাশ করেন। ওই নীতি বিবৃতিতে আইএমএফ ২০১৯ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকের প্রতিবেদনকে বিশ্লেষণ করে অর্থ মন্ত্রণালয় পাঁচ বছরের কর-জিডিপি অনুপাতের চিত্র তুলে ধরেছিল। তাতে বলা হয়েছিল, ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৭-১৮ পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত ছিল গড়ে ১০ দশমিক ২ শতাংশ।
এ হিসাবে কয়েক বছরে দেশে কর-জিডিপি অনুপাত অনেক কমে গেছে। এর মূল কারণ, জিডিপির আকার বাড়লেও সে অনুপাতে কর না বাড়াকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। মূলত এ কারণে ঋণের চতুর্থ কিস্তি ছাড় করার আগে কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধির শর্ত কঠিন করে আইএমএফ। এর পরিপ্রেক্ষিতে অর্থবছরের মাঝামাঝি গত জানুয়ারিতে বিভিন্ন পণ্যের ওপর পরোক্ষ কর বৃদ্ধি করে অন্তর্বর্তী সরকার। যদিও বিভিন্ন মহলের চাপে তা আবার কিছুটা হ্রাস করা হয়েছে।