আজ বদর দিবস
প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ মার্চ ২০২৫, ৩:০০:২৪ অপরাহ্ন
মোবারক হো মাহে রমজান
মুনশী ইকবাল : আজ ১৭ রমজান। ইসলামের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে এ দিন সংঘটিত হয়েছিল ঐতিহাসিক বদরের যুদ্ধ। বদরের যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ এবং অবিস্মরনীয় ঘটনা। ২৬ জুলাই ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দ মোতাবেক ১৭ রমজান ২য় হিজরি মুসলমান এবং কুরাইশদের মাঝে বদরের প্রান্তরে যে যুদ্ধ হয়েছিল ইসলামের ইতিহাসে সেটাই ঐতিহাসিক বদরেরযুদ্ধ। এটিকে বদরে আকবারও বলা হয়।
মদিনা থেকে প্রায় ৮০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে বদর প্রান্তরের অবস্থান। এ নিয়ে বায়ানুল কুরআনে মাওলানা আশরাফ আলী থানবী র. বলেন, বদর হচ্ছে একটি কূপের নাম। কুরাইশরা এ কূপ খনন করেছিল। এই কূপের নামানুসারেই কূপের নিকটবর্তী প্রান্তরকে বদর বলা বলা হয়।
রাসূল সা. এর যুগে ছোটো বড়ো কমবেশি ৮৯টি যুদ্ধাভিযান হয়। তবে ইতিহাস থেকে প্রমাণিত রাসূল সা. স্বেচ্ছায় কোনো যুদ্ধে লিপ্ত হননি। কারো বিরুদ্ধে তলোয়ারের শক্তি ব্যবহার করেন নি। ইসলাম প্রচারে তাঁর মূল হাতিয়ার ছিল আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস এবং মানবতার প্রতি উদারতা। তাঁর ব্যবহার দেখে মানুষ আকৃষ্ট হয়ে ইসলামে এসেছে। তাঁর যুদ্ধ ছিল আত্মরক্ষামূলক, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অসত্যের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে। কাফিরদের অত্যাচরের সীমা যখন ছাড়িয়ে যাচ্ছিলো তখন আল্লাহর নির্দেশে তিনি কাফিরদের বিরুদ্ধে অভিযানে নামেন। বদরের যুদ্ধ ছিল ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে বড়ো যুদ্ধ। যদি মুসলমানরা এ যুদ্ধে পরাজিত হতেন ইসলাম জগতের বুক থেকে একেবারেই মুছে যেতো কিংবা কয়েক শত বা কয়েক হাজার বছর পিছিয়ে যেতো বলে মনে করা হয়। কারণ এটি কোনো রাজ্য বিজয়ের যুদ্ধ ছিল না। এটি ছিল ঈমান বা বিশ্বাসের সাথে অবিশ্বাসের লড়াই।
বদরের যুদ্ধ ছিল হক এবং বাতিলের মাঝে প্রথম মীমাংসাকারী সামরিক অভিযান। কুরাইশরা মর্মে মর্মে বুঝতে পেরেছিল, মদিনায় নব প্রতিষ্ঠিত ইসলামের দুর্নিবার শক্তিকে সমূলে ধ্বংস করতে না পারলে তাদের পতন অনিবার্য। এরই জের ধরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুরাইশদের প্রথম মিলিত আক্রমন হলো ঐতিহাসিক বদরের যুদ্ধ। ইসলামের ইতিহাসে এটি প্রথম প্রকাশ্য ঘোষিত সশস্ত্র যুদ্ধ, যে যুদ্ধে কুরাইশদের সাথে মুসলমানদের প্রচন্ড মুকাবিলা হয়। এ যুদ্ধে কুরাইশদের সংখ্যা ছিল একহাজার আর মুসলমানদের তিনশ এর কিছু বেশি।
বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের সংখ্যা নিয়ে কিছুটা মতভেদ রয়েছে। কারো মতে ৩১৩, কারো মতো ৩১৪, কারো মতে ৩১০, করো মতে ৩১৭। তবে এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই যে বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল তিনশতাধিক।
এ যুদ্ধে মুসলিম শক্তির মহান বিজয় সূচিত হয়। দুনিয়ার ইতিহাসে ঘটে যাওয়া অনেক বড়ো বড়ো যুদ্ধের চেয়ে বদরের যুদ্ধের গুরুত্ব অনেক বেশি এবং সুদূরপ্রসারী। কুরআনুল কারিমের সূরা আনফালে আল্লাহ তায়ালা এ নিয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করেছেন। এছাড়া কুরআনের অন্যান্য জায়গায় সংক্ষিপ্ত আকারে এ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এ বিজয়কে আল্লাহর বিরাট এক অনুগ্রহ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
এ যুদ্ধে ইবলিস শয়তান সরাসরি মানুষের রূপ ধরে তার বাহিনী নিয়ে এসেছিল। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ যুদ্ধে কুরাইশদের মুকাবেলায় হজরত জিবরাঈল ও মিককাঈল আ. এর নেতৃত্বে ফেরেশতাদের বাহিনী পাঠিয়ে দিলেন। ইমাম ইবনে জারীর হজরত ইবনে আব্বাস রা. এর রেওয়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, শয়তান যখন মানুষের আকৃতিতে সুরাকা ইবনে মালিকের রূপ ধরে নিজ বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিল তখন সে ফেরেশতাদের বাহিনী দেখে ভয় পেলো। সে বুঝলো তার আর বাঁচার সুযোগ নেই। সে তার বাহিনী নিয়ে পালিয়ে গেল।
এ নিয়ে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনুল কারিমে সূরা আনফালে ৪৮ নম্বর আয়াতে বলেছেন, যখন শয়তান তাদের কাজগুলো তাদের সামনে খুব চাকচিক্যময় করে পেশ করেছিল এবং সে তাদের বলেছিল, আজ মানুষের মধ্যে কেউই তোমাদের উপর বিজয়ী হতে পারবে না এবং অবশ্যই আমি তোমাদের পাশে আছি, অতপর যখন উভয় দল সামনাসমনি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লো, তখন সে কেটে পড়লো এবং বললো, তোমাদের সাথে আমার কোনোই সম্পর্ক নেই, আমি এমন কিছু দেখতে পাচ্ছি যা তোমরা দেখতে পাওনা, আমি অবশ্যই আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করি, (কেননা) আল্লাহ তায়ালা হচ্ছেন কঠোর শাস্তিদাতা’।
সুরাকা ছিল বিখ্যাত এক আরব গোত্রের সর্দার। সুরাকার রূপে শয়তানের পালানো দেখে কুরাইশদের মনোবল অনেকখানি ভেঙে গেল। ইমাম ইবনে কাসীর বলেছেন, অভিশপ্ত শয়তানের এটি একটি সাধারণ অভ্যাস যে, সে মানুষকে খারাপ কাজে লিপ্ত করে দিয়ে ঠিক সময়মতো আলাদা হয়ে যায়। আর এর পাশাপাশি কুরাইশদের যে কী করুন অবস্থা হয়েছিল তা আল্লাহ সূরা আনফালের ৫০ নম্বর আয়োতে বর্ণনা করেছেন।
‘তুমি যদি (সত্যিই) সেই অবস্থাটা দেখতে পেতে, যখন ফেরেশতারা কাফিরদের রূহ বের করে নিয়ে যাচ্ছিল, ফেরেশতারা তাদের মুখে আর পিঠে আঘাত করে যাচ্ছিল (এবং বলছিল) তোমরা আগুনের আজাব উপভোগ করো’।
মূল কথা হলো বদরের যুদ্ধে আল্লাহর সাহায্য সরাসরি প্রত্যক্ষ করা গিয়েছিল। এর আগের রাতে রাসূল সা. সারাররাত জেগে তাহাজ্জুদে নিমজ্জিত ছিলেন। এ রাতে প্রচন্ড বৃষ্টি হয়। কুরাইশরা যে জায়গায় অবস্থান করছিল সেখান দিয়ে প্রচন্ড ঝড় বয়ে যায়। কাফিররা উপত্যকার নিচের দিকে ছিল, ফলে সেখানে বৃষ্টির পানি জমা হয়ে কাদার সৃষ্টি করে। এতে কাফেররা ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছিল না।
এ নিয়ে আল্লাহ সূরা আনফালের ১১ নম্বর আয়াতে বলেছেন, ‘(মনে করে দেখো) যখন আল্লাহ তাঁর পক্ষ থেকে তোমাদের নিরাপত্তা ও স্বস্থির জন্য তোমাদের তন্দ্রায় আচ্ছন্ন করে দিচ্ছিলেন, তোমাদের উপর তিনি আকাশ থেকে বৃষ্টির পানি নাজিল করেছেন, যেন এ দ্বারা তিনি তোমাদের পাকসাফ করতে পারেন, তোমাদের মন থেকে শয়তানের অপবিত্রতা দূর করতে পারেন, তোমাদের মনে সাহস বৃদ্ধি করতে পারেন, (সর্বোপরি যুদ্ধের ময়দানে) তিনি এর মাধ্যমে তোমাদের পদক্ষেপ মজবুত করতে পারেন’।
যুদ্ধের আগে আল্লাহর রাসূল সা. সাহাবাদের নিয়ে আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন। দোয়ায় রাসূল সা. এতো গভীরে চলে গেলেন এবং কান্নাকটি করলেন যে তাঁর শরীর থেকে চাদর মোবারক পড়ে যায়। হজরত আবু বকর রা. পুনরায় তাঁর শরীরে চাদর পড়িয়ে দেন। আল্লাহ রাসূল সা. এর দোয়া কবুল করেছিলেন।
আনফালের ৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলছেন, মনে করে দেখো, তোমাদের রবের কাছে সাহায্য চেয়েছিলে, তিনি তোমাদের দোয়া কবুল করেছিলেন এবং বলেছিলেন, আমি তোমাদের সাহায্য করবো এক হাজার ফেরেশতা দিয়ে, যারা একের পর এক আসবে। দোয়া শেষে রাসূল সা. খুশি মুখে মুসলমানদের আল্লাহর ভবিষ্যত বাণী জানিয়ে দিলেন। যা সূরা ক্বামারের ৪৫ নম্বর আয়াতে এসেছে। ‘শীঘ্রই সৈন্যদলকে পরাস্ত করা হবে এবং তারা পিঠ দেখিয়ে পালিয়ে যাবে’।
এরপর কাফিরদের সাথে ঈমাদদারদের প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে মুসলমানরা বিজয়ী হন। এ যুদ্ধে কাফিরদের ৭০ জন নিহত হয়। আর এতে ১৪ জন সাহাবা শাহাদাত বরণ করেন। তাদের বদরের প্রান্তরেই দাফন করা হয়।
বদরের যুদ্ধ মুসলমানদের জন্য কিয়ামত পর্যন্ত একটি শিক্ষার বিষয়। এখান থেকে মুসলমানরা জানতে পারেন আল্লাহর দ্বীনের জন্য লাড়াইয়ে সংখ্যা কম বেশি কোনো বিষয় নয়। আল্লাহর সাহায্য আর ঈমানী চেতনাই মূল বিষয়। আল্লাহর সাহায্য থাকলে যেকোনো কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করা যায়। কাফের আর তাদের দোসররা যতই ষড়যন্ত্র করুক আল্লাহর দ্বীনের কোনো ক্ষতি তারা করতে পারবে না। এটা আল্লাহর ওয়াদা। সূরা সফের ৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলছেন, এ লোকেরা তাদের মুখের ফুঁ দিয়ে আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়, অতচ আল্লাহ তাঁর এ নূর পরিপূর্ণ করে দিতে চান, কাফেররা তা যতোই অপছন্দ করুক।