সিলেটে বজ্রপাতে দেড় মাসে ১৪ মৃত্যু
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ মে ২০২৫, ১২:১০:১৯ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার : সিলেট অঞ্চলে ঝড় বৃষ্টির মৌসুম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সিলেটে বজ্রপাতে বেড়েছে মৃত্যু। এই অঞ্চলে রীতিমত ভয়ংকর আতংকের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে বজ্রপাত। দেড় মাসে বিভাগে বজ্রপাতে মারা গেছেন ১৪ জন। এরমধ্যে সর্বোচ্চ ৬ জন মারা গেছেন সুনামগঞ্জ জেলায়। যার অধিকাংশই কৃষক। আর সবার মৃত্যু হয়েছে হাওরে। সর্বশেষ ১ মে বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলায় বজ্রপাতে মারা গেছেন ২ জন। তারা জেলার দিরাই ও জামালগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা। দুজনের মৃত্যু হয়েছে হাওরে।
আবহাওয়াবিদদের মতে, চলতি মৌসুমে প্রচন্ড গরমের পর হঠাৎ বৃষ্টির কারণে বেড়েছে বজ্রপাতের প্রবণতা। সিলেটের ওপর দিয়ে তীব্র বজ্রপাত ও মাঝারি বৃষ্টিপাতের শঙ্কা এখনো কাটেনি। তাই সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর বজ্রপাতে গড়ে আড়াই থেকে তিনশ মানুষ প্রাণ হারান, যার ৯৩ শতাংশই গ্রামাঞ্চলে। দেশের ১৫টি বজ্রপাত ‘হটস্পট’-এর মধ্যে অন্যতম সিলেট, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ। এসব এলাকায় উন্মুক্ত হাওরাঞ্চল থাকায় বজ্রপাতে মৃত্যুর হার তুলনামূলকভাবে বেশি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে সিলেটে বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছেন ১৪ জন। নিহতদের অধিকাংশই ছিলেন কৃষিকাজে নিয়োজিত ছিলেন। গত ১৮ মার্চ থেকে শুরু করে ১ মে পর্যন্ত সময়ে সিলেট বিভাগে বজ্রপাতে ১২ জনের মৃত্যু ঘটে। নিহতদের মধ্যে সুনামগঞ্জেই মৃত্যু হয়েছে ৮ জনের, হবিগঞ্জে ৩ জন, মৌলভীবাজারে ১ জন এবং সিলেটে ২ জন। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ধান কাটতে গিয়ে খোলা মাঠে বজ্রাঘাতে।
জানা গেছে, সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার (১মে) দুুপরে পৃথক বজ্রপাতে সুনামগঞ্জ জেলায় দুই জনের মৃত্যু হয়েছে। জামালগঞ্জ ও দিরাই উপজেলায় পৃথক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। জামালগঞ্জ উপজেলার ফেনারবাঁক ইউনিয়নে পাকনার হাওরে ধান কাটার সময় বজ্রপাতে মানিক মিয়া (৩৫) নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়। বজ্রপাতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। মানিক মিয়া উপজেলার লক্ষীপুর গ্রামের মৃত হোসেন আলীর ছেলে।
একই দিনে দিরাই উপজেলার চরনারচর ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামের হাওরে ট্রলিতে করে ধান আনতে গিয়ে বজ্রপাতে রিংকু দাস (৩০) নামের এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। তিনি গোপালপুর গ্রামের মৃত রনধীর দাসের ছেলে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২৮ এপ্রিল একদিনে সিলেট বিভাগে ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে বজ্রপাতে। এরমধ্যে সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলায় বজ্রপাতে রিমন তালুকদার নামে এক কলেজছাত্রের মৃত্যু হয়। হাওরে গরুকে ঘাস খাওয়াতে গিয়েছিলেন তিনি। এসময় তার সাথে থাকা গবাদিপশুরও মৃত্যু হয়। এদিকে, হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার হাওরে বজ্রপাতে দুর্বাসা দাস নামে এক ধান কাটা শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এছাড়াও এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও ৩ জন। অপরদিকে, মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়নের শ্রীধরপুর গ্রামে ধান কাটার সময় বজ্রপাতে মাখন রবি দাস নামে আরো এক চা শ্রমিকের মৃত্যু হয়।
২৫ এপ্রিল সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলায় বজ্রপাতে জীবন মিয়া নামে দুবাই প্রবাসী যুবকের মৃত্যু হয়। বিকেলে বাদ আসর মাঠে গরু আনতে গেলে বজ্রপাতে সেখানেই তার মৃত্যু হয়।২৩ এপ্রিল সন্ধ্যায় সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার সেচনী গ্রামে বজ্রপাতে প্রাণ হারান ২০ বছর বয়সী কৃষক আবু আইয়ূব। তিনি মাঠে ধানের খড় সংগ্রহ করছিলেন। এর একদিন আগে, একই উপজেলার ২২ এপ্রিল চন্ডিপুর গ্রামে ধান কাটতে গিয়ে বজ্রাঘাতে মারা যান ভোলার রসুলপুরের ইকবাল হোসেন, যিনি দিনমজুর হিসেবে কাজ করছিলেন। একইদিন সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে কুশিয়ারা নদীতে নৌকা চালাতে গিয়ে বজ্রাঘাতে প্রাণ হারান জিলান মিয়া।
এর আগেও, ১৬ এপ্রিল হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জে শিবপাশা হাওরে ধান কাটার সময় মারা যান চাঁপাইনবাবগঞ্জের দুই শ্রমিক-মনিরুল ইসলাম ও কপিল উদ্দিন। এছাড়া ১৫ এপ্রিল সুনামগঞ্জের ছাতক ও শান্তিগঞ্জ উপজেলায় মারা যান দুই কৃষক-আমির উদ্দিন ও দেলোয়ার হোসেন। ১৮ মার্চ ভোররাতে দোয়ারাবাজার উপজেলার বাঁশতলায় বজ্রপাতে প্রাণ হারান সাইদুল ইসলাম নামের এক যুবক, যিনি টিউবওয়েল থেকে পানি তুলছিলেন।
বিশ্লেষকদের মতে, শহরে বেশিরভাগ ভবনে বজ্র নিরোধক দ- থাকায় বজ্রপাতে মৃত্যু তেমন হয় না। কিন্তু গ্রামে তা না থাকা ও বড় গাছপালা কমে গিয়ে খোলা মাঠের কারণে সেখানে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। দেশের হাওর এলাকায় বজ্রপাতে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। কারণ সেখানকার বেশিরভাগ ফসলি জমিতে বড় কোনো গাছ নেই।
বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন সময় বলেছেন, সিলেটে বজ্রপাত বেশি হয়, ওই ধারণার একটি ভিত্তি আছে। প্রাকৃতিকভাবেই বৃষ্টিপাতের সঙ্গে বজ্রপাতের একটা সম্পর্ক আছে। এছাড়া মানবসৃষ্ট পরিবেশ-বিধ্বংসী কর্মকা-ও বজ্রপাতের মত দুর্যোগ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মো. আনোয়ারুল ইসলাম সিলেট অঞ্চলের বৃষ্টিপাতকে বলেছেন, ‘সাংঘার্ষিক বৃষ্টি’। অর্থাৎ সাগর থেকে মৌসুমি বায়ু এসে সীমান্তবর্তী মেঘালয় রাজ্যের খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়, তাতেই বৃষ্টি ঝরে।
তিনি বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও মেঘালয়ের পাহাড়ের পাদদেশে যে উষ্ণ পরিবেশ, এটার সঙ্গে সাগর থেকে বাতাসের আসা আর্দ্রতার উপাদানের সংঘর্ষ বাঁধে। পরিবেশের স্বাভাবিক যে প্রক্রিয়া সেটাতে বাঁধা দেয়। এতে সাংঘর্ষিক বৃষ্টিপাত হচ্ছে। আর সাংঘর্ষিক বৃষ্টিপাত হলে বজ্রপাতের পরিমাণটা বেড়ে যায়। এছাড়া মানবসৃষ্ট কারণগুলোর মধ্যে ‘স্থানীয় ফোর্সিং’ এবং ‘গ্লোবাল ফোর্সিং’ মিলে অধিক বজ্রপাতকে প্রভাবিত করছে বলে ধারণা দেন অধ্যাপক আনোয়ার।
তিনি বলেন, গবেষণায় পেয়েছি, এক দশকে সিলেটে ভূমি ব্যবহারের আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। জলাশয়ের পরিমাণ কমে গেছে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। এটা স্থানীয় ফোর্সিং। যেমন- ২০১০ সালে সিলেটে মোট জমির ৩০ শতাংশ কৃষিতে ব্যবহার হত। এখন সেটার পরিমাণ বেড়ে ৭০ শতাংশ দাঁড়িয়েছে। খাদ্যের অভাব মেটানোর জন্য এটা ভালো। কিন্তু এসব হাওরগুলো তো ছিল পানির আধার। সেটা হারিয়ে গেছে। এটা তাপমাত্রার দ্রুত পরিবর্তন, আর্দ্রতার তারতম্য সৃষ্টি ও ভূতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য সৃষ্টি করছে।
আর ‘গ্লোবাল ফোর্সিং’ হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন, উষ্ণায়নের বিষয়গুলো। স্থানীয় ফোর্সিং’ বজ্রপাতের উপযুক্ত পরিস্থিতি তৈরি করে, আর ‘গ্লোবাল ফোর্সিং’ এই ধরনের ঘটনাকে বাড়িয়ে দেয়। এ কারণে, বজ্রপাতের সংখ্যা এবং তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেটাই সিলেট অঞ্চলে প্রতিফলিত হচ্ছে।
এ ব্যাপারে সিলেট আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ সজীব হোসাইন দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, বৈশাখ মওসুমে বজ্রপাত হওয়াটা স্বাভাবিক। শুধু সিলেট নয়, বাংলাদেশে মার্চ-এপ্রিল-মে এই তিন মাসে বজ্রপাত বেশী হয়। তাই আমরা সব সময় সতর্ক করি। বিশেষ করে এপ্রিলে বৈশাখ মাস থাকায় হাওর পাড়ের মানুষ বোরো ধান তোলায় ব্যস্ত থাকেন। সেজন্য এই সময়টাতে বজ্রপাতে মৃত্যুটা বেশী হয়।
তিনি বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে এখন কোনকিছুই ঠিকভাবে চলছেনা। এখন দেখা যায় জুলাই-আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসেও বজ্রপাত হয়। এই সময়েও মৃত্যু ঘটে। বজ্রপাতের মৃত্যু কমিয়ে আনতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি বজ্রপাতের সময়টাতে যতটা সম্ভব সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।