স্বাধীন ‘বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সার্ভিস’ গঠনসহ ৩২ সুপারিশ
প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ মে ২০২৫, ১২:১০:৪১ অপরাহ্ন
প্রাথমিক চিকিৎসা ফ্রি, স্বাস্থ্যে ১৫% বরাদ্দের প্রস্তাব
জালালাবাদ রিপোর্ট : রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে গঠিত স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে। প্রতিবেদনে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র ‘বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সার্ভিস’ গঠনসহ মোটাদাগে ৩২টি সুপারিশ করা হয়েছে।এছাড়া রোগীর সুরক্ষা, আর্থিক বরাদ্দ ও ধারাবাহিকতা, জবাবদিহিতা ও জরুরি প্রস্তুতি নিশ্চিত করাসহ পুরোনো আইন পর্যালোচনা ও যুগোপযোগী করার পাশাপাশি নতুন আইন প্রণয়নের প্রস্তাব করেছে কমিশন।
প্রস্তাবিত আইনগুলো হলো, বাংলাদেশ স্বাস্থ্য কমিশন আইন, বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস আইন, প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা আইন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন, ওষুধের মূল্য নির্ধারণ ও প্রবেশাধিকার আইন, অ্যাপলায়েড হেলথ প্রফেশনাল কাউন্সিল আইন ও বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল আইন।
এছাড়াও বিনামূল্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, স্বাস্থ্যখাতে ১৫ শতাংশ বাজেট বরাদ্দ, সরকারি হাসপাতালে জনবল নিয়োগ, অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা বৃদ্ধি, রোগীদের বিদেশমুখিতা কমাতে নতুন হাসপাতাল নির্মাণের প্রস্তাব করেছে কমিশন।
জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খানের নেতৃত্বে এই কমিশনের সদস্যরা সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার হাতে প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন। ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অধ্যাপক এ কে আজাদকে প্রধান করে ১২ সদস্যবিশিষ্ট স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন গঠন করে। এর মধ্য দিয়ে দুই ধাপে গঠিত ১১ সংস্কার কমিশনের সবগুলো প্রতিবেদন সরকারপ্রধানের দপ্তরে জমা পড়ল।
কমিশনের মুখ্য সুপারিশে সংবিধান সংশোধন করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এই সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য একটি পৃথক ‘প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা আইন’ প্রণয়ন করতে হবে, যা বিনা মূল্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির ব্যাপারে নাগরিকদের অধিকার ও রাষ্ট্রের কর্তব্য নির্ধারণ করবে। স্বাস্থ্য খাতে দীর্ঘ মেয়াদে ন্যায্যতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করবে।
কমিশন বেশ কিছু আইন সংস্কার ও নতুন আইন প্রণয়নের সুপারিশ করেছে। সুপারিশে বলা হয়, সব সংশ্লিষ্ট পুরোনো আইন পর্যালোচনা করে যুগোপযোগী করতে হবে। এ ছাড়া রোগী সুরক্ষা, আর্থিক বরাদ্দ, জবাবদিহি ও জরুরি অবস্থায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিশ্চিত করতে কিছু নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে। কমিশন প্রস্তাবিত নতুন আইনগুলো হলো বাংলাদেশ স্বাস্থ্য কমিশন আইন; বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস আইন; জনস্বাস্থ্য ও অবকাঠামো আইন; বাংলাদেশ সেইফ ফুড, ড্রাগ, আইভিডি ও মেডিকেল ডিভাইস আইন; ওষুধের মূল্য নির্ধারণ ও প্রাপ্তি আইন; স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ও রোগী নিরাপত্তা আইন; অ্যালায়েড হেলথ প্রফেশনাল কাউন্সিল আইন; হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক অ্যাক্রেডিটেশন আইন; স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন; নারী স্বাস্থ্য আইন; ক্যানসার নিয়ন্ত্রণ আইন; শিশু বিকাশ কেন্দ্র আইন; বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল আইন; স্বাস্থ্য তথ্য সুরক্ষা আইন ও স্বাস্থ্য খাতে টেকসই অর্থায়ন আইন। এ ছাড়া নি¤œলিখিত আইনগুলোর সংশোধন প্রয়োজন: বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল আইন, মেডিকেল শিক্ষা অ্যাক্রেডিটেশন আইন, নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিল আইন, বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিল আইন, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন, পৌর ও সিটি করপোরেশন আইন ইত্যাদি।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য কমিশন গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, একটি স্বাধীন ও স্থায়ী ‘বাংলাদেশ স্বাস্থ্য কমিশন’ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই কমিশন স্বাস্থ্যবিষয়ক নীতি প্রণয়নে সংসদ ও সরকারকে কৌশলগত পরামর্শ দেবে। পাশাপাশি এটি জাতীয় কৌশল, সেবা ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের মানদ- এবং ক্লিনিক্যাল গাইডলাইন প্রণয়ন করবে। কমিশন নিয়মিতভাবে স্বাস্থ্যব্যবস্থার কার্যকারিতা, সেবার গুণগত মান ও সার্বিক ব্যয় সাশ্রয় পর্যালোচনা করবে। এর ভিত্তিতে কমিশন বাস্তবায়নকারী সংস্থা ও সরকারকে উন্নয়নের জন্য গঠনমূলক মতামত ও দিকনির্দেশনা প্রদান করবে। এই কমিশন সরাসরি সরকারপ্রধানের কাছে জবাবদিহি করবে। প্রতিবছর একটি বার্ষিক প্রতিবেদন সংসদে পাঠাবে।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, পেশাদারি, দক্ষতা ও জবাবদিহিমূলক সেবার মান নিশ্চিত করতে বিদ্যমান স্বাস্থ্য ক্যাডার, অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ক্যাডার এবং স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন সব জনবল নিয়ে প্রশাসনিকভাবে স্বায়ত্তশাসিত ও পেশাভিত্তিক একটি নতুন সিভিল সার্ভিস-বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস গঠন (বিএইচএস) করতে হবে। প্রতিবেদনে স্বতন্ত্র পাবলিক সার্ভিস কমিশন (স্বাস্থ্য) গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য খাতের নিয়োগ ও পদোন্নতিপ্রক্রিয়া নিয়মিতকরণ ও স্বচ্ছতা আনয়নের লক্ষ্যে একটি স্বতন্ত্র পাবলিক সার্ভিস কমিশন (স্বাস্থ্য) গঠন করতে হবে।
প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়েছে, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার সর্বজনীন প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে সরকারকে এই সেবা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে (ক্ষেত্রবিশেষ ভর্তুকি মূল্যে) দিতে হবে। যাতে কোনো নাগরিক আর্থিক প্রতিবন্ধকতার কারণে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত না হন।
প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়েছে, উপজেলা পর্যায়ে সেকেন্ডারি স্বাস্থ্যসেবা জোরদার করে জনগণের জন্য স্বাস্থ্যসেবাকে আরও সহজলভ্য করতে হবে। জেলা হাসপাতালগুলোয় বিশেষায়িত (টারশিয়ারি স্তরের) চিকিৎসাসেবা চালু করতে হবে, যাতে সেবার বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত হয়, মেডিকেল কলেজ ও জাতীয় ইনস্টিটিউটগুলোর ওপর রোগীর চাপ কমানো যায়, ভৌগোলিক কারণে কেউ বিশেষায়িত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত না হন। প্রতিটি বিভাগীয় সদরে অন্তত একটি পূর্ণাঙ্গ, সর্বাধুনিক সুবিধাসম্পন্ন ও বিশ্বমানের টারশিয়ারি সেবা হাসপাতালের প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে হবে, যা জটিল ও বিশেষায়িত চিকিৎসার জন্য একটি আঞ্চলিক রেফারেল কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে। এই হাসপাতালগুলো নতুনভাবে গড়ে তোলা যেতে পারে, অথবা বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধাপে ধাপে উন্নীত করে করা যেতে পারে। প্রতি রোগীর জন্য গড়ে ১০ মিনিটের পরামর্শ সময় নিশ্চিত করতে হবে, এজন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক সেবা প্রদানকারীর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে এবং সাপ্তাহিকভাবে প্রেসক্রিপশন নমুনা যাচাইয়ের পদ্ধতি চালু করা হবে। অতি দরিদ্র বা যাঁরা দেশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ, তাঁরা সব হাসপাতালে বিনা মূল্যে সব সেবা পাবেন। দেশের সব সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি হাসপাতালের রক্ত সঞ্চালন সেবা, ল্যাবরেটরি সেবা ও ফার্মেসি ২৪/৭ খোলা থাকবে। হাসপাতালে মানোন্নয়নের জন্য কার্যকর মান উন্নয়ন পর্ষদ ও কন্টিনিউড এডুকেশন পদ্ধতির ব্যবস্থা থাকতে হবে।
সুপারিশে বলা হয়, জরুরি চিকিৎসাকে একটি বিশেষায়িত ও অত্যাবশ্যকীয় স্বাস্থ্যসেবা হিসেবে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় একে একটি স্বীকৃত চিকিৎসা বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
সুপারিশে বলা হয়, স্বাস্থ্য পরিষেবাগুলোর প্রাপ্যতা, মান ও পরিব্যাপ্তি নিশ্চিত করতে জাতীয় ফার্মেসি নেটওয়ার্ক, জাতীয় ডায়াগনস্টিক ল্যাবরেটরি নেটওয়ার্ক, জাতীয় রক্ত সঞ্চালন নেটওয়ার্ক এবং জাতীয় অ্যাম্বুলেন্স নেটওয়ার্ক গঠন করতে হবে।
এদিকে, দেশের স্বাস্থ্য খাতে দীর্ঘদিন ধরে যেসব সমস্যা রয়েছে, তা নিরসনে স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে উল্লেখ করে যেসব সুপারিশ এখনই বাস্তবায়নযোগ্য, তা দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশনের এই প্রতিবেদনকে যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে অভিহিত করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, স্বাস্থ্য খাতের সমস্যাগুলো বহুদিনের সমস্যা, এর মাধ্যমে আমরা যদি এসব সমস্যার সমাধান করতে পারি, তা হবে যুগান্তকারী ঘটনা।
চিকিৎসাব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণের ওপর জোর দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এটা ছাড়া সমস্যা নিরসন সম্ভব নয়। চিকিৎসকদের যেখানে পোস্টিং, সেখানে থাকাটা নিশ্চিত করতে হবে।