রয়টার্সের অনুসন্ধান : কোন চালে পারমাণবিক যুদ্ধ থেকে ফিরলো ভারত-পাকিস্তান
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ মে ২০২৫, ৯:৫৬:৩৯ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : শনিবারের ঘটনাবলির সূত্রপাত হয়েছিল এক সর্বাত্মক যুদ্ধের আশঙ্কা নিয়ে। তবে সন্ধ্যায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প-দুই দেশ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে, এমন ঘোষণা দেওয়ার পর এ আশঙ্কা দূর হয়। রয়টার্স যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও পাকিস্তানের ১৪ জন কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার এবং তিন দেশের রাজধানী থেকে প্রকাশিত সরকারি বিবৃতি পর্যালোচনার ভিত্তিতে এ তথ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে।
এসব সূত্র তুলে ধরে, কীভাবে মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে শত্রুতাপূর্ণ পরিস্থিতি দ্রুতই বিপজ্জনক রূপ ধারণ করে; সঙ্গে পর্দার আড়ালে জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতা চলে। এই তৎপরতায় যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও পাকিস্তান সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ওয়াশিংটনের মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আহমাদ সুবহান ও নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুজন পাকিস্তানি নিরাপত্তা কর্মকর্তার বলেন, নূর খান বিমানঘাঁটিতে অন্তত দুটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ও ড্রোন দিয়ে আক্রমণ চালানো হয়।
এ হামলায় দুটি ছাদ ধসে পড়ে এবং একটি জ্বালানি সরবরাহকারী বিমানের হ্যাঙ্গার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘাঁটি পরিদর্শনকারী এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা জানান, হামলার সময় বিমানটি আকাশে ছিল।
তবে ভারতের এক শীর্ষস্থানীয় সেনা কর্মকর্তা গত রোববার সাংবাদিকদের জানান, নূর খান ঘাঁটির একটি অপারেশন কমান্ড সেন্টারে হামলা চালানো হয়েছে।পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার রয়টার্সকে বলেন, আমাদের রাজধানীর একেবারে কাছাকাছি নূর খান বিমানঘাঁটিতে হামলার পর আমাদের জন্য প্রতিশোধ নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।
পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচির পরিকল্পনার দায়িত্বে থাকা সামরিক সংস্থার কাছ থেকে মাত্র এক মাইলের দূরত্বে নূর খান বিমানঘাঁটি অবস্থিত।যুক্তরাষ্ট্রের আলবানি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ক্রিস্টোফার ক্ল্যারির মতে, এই ঘাঁটিতে হামলার ঘটনা ভারতের লক্ষ্য-অভিপ্রায়ের তুলনায় অনেক বেশি বিপজ্জনক ছিল বলে ধরা যায়। দুই দেশকেই এ বার্তা স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে যে এমন একটি সংঘাত পারমাণবিক রূপ না নিয়ে সীমাবদ্ধ থাকবে বলে ধরে নেওয়া ভুল হতে পারে। আপনি যদি রুশ রুলেট খেলেন (একধরনের জুয়া) ও ধরা খাওয়া থেকে বেঁচে যান, তার মানে এই নয় যে একই কাজ আবার করাই ঠিক হবে, বলেন ক্ল্যারি।
এসব বিষয়ে ভারতের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রয়টার্সের লিখিত প্রশ্নের তাৎক্ষণিক কোনো জবাব দেয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র এ সংঘাত নিরসনে দেশটির ভূমিকা নিয়ে রয়টার্সের করা প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিলেও বলেন, দুই দেশের মধ্যে সামরিক উত্তেজনা আরও বাড়লে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য তা মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠতে পারত।
মোদিকে ভ্যান্সের টেলিফোন :
ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীনতালাভের পর থেকে তিনটি বড় যুদ্ধে লড়েছে এবং দীর্ঘদিন ধরেই তারা দ্বন্দ্বে লিপ্ত রয়েছে। তাদের মধ্যে সাম্প্রতিকতম উত্তেজনার সূচনা ঘটে গত ২২ এপ্রিল ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের এক হামলার মাধ্যমে।
কাশ্মীরকে ঘিরে বহুদিনের বিবাদের সর্বশেষ পর্ব এটি। হিমালয় অঞ্চলের এ ভূখ- আশির দশকের শেষ থেকে ভারতবিরোধী বিদ্রোহে ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে। কাশ্মীরের পুরো অংশ নিজেদের বলে দাবি করে থাকে নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদ উভয়েই, যদিও তারা এর একটি করে অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে।
হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিবেশী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জম্মু ও কাশ্মীরে সক্রিয় সশস্ত্র সংগঠনগুলোকে সহায়তা ও অস্ত্র সরবরাহের অভিযোগ করে আসছে। তবে পাকিস্তান বলছে, তারা শুধু কাশ্মীরি স্বাধীনতাকামীদের কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে থাকে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অনুমোদনের পর তাঁর দেশের সেনাবাহিনী পেহেলগামের ঘটনায় ৭ মে পাকিস্তানে ‘সন্ত্রাসীদের অবকাঠামো’ লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালায়।
পরবর্তী সময়ে শুরু হওয়া আকাশযুদ্ধে পাকিস্তান জানায়, তারা ভারতের পাঁচটি যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করেছে, যার মধ্যে ছিল সম্প্রতি ফ্রান্স থেকে কেনা মূল্যবান রাফাল বিমানও। ভারতের পক্ষ থেকেও ইঙ্গিত দেওয়া হয়, তারা কিছু ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে এবং পাল্টা আঘাত হেনেছে।
৯ মে (শুক্রবার) যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন যে এই সংঘাত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে, এমনটা জানান ঘটনাটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুটি সূত্র।
সূত্র দুটি জানায়, সেদিন সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে টেলিফোন করেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে একটি সম্ভাব্য সমঝোতার প্রস্তাব দেন, যা তাঁর ভাষায়, পাকিস্তানের পক্ষেও গ্রহণযোগ্য হবে।
যদিও এর আগের দিন বৃহস্পতিবার ভ্যান্স প্রকাশ্যে বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ‘দুই দেশের এমন একটি ঘটনায় জড়াবে না, যা মূলত আমাদের নিজস্ব বিষয় নয়’।সূত্রগুলো ওই ফোনালাপের বিস্তারিত জানায়নি। তবে তারা বলেছে, মোদি প্রস্তাব গ্রহণ করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন না। একটি সূত্র বলেছে, মোদি ভ্যান্সকে জানান, যদি পাকিস্তান উত্তেজনা বাড়ায়, তবে ভারত আরও জোরালো প্রতিক্রিয়া দেখাতে প্রস্তুত থাকবে। উল্লেখ্য, পেহেলগাম হামলার সময় ভ্যান্স ভারত সফরে ছিলেন।
ভারতীয় কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, ফোনালাপের ঘণ্টা কয়েক পর ভারত–পাকিস্তান উত্তেজনার চূড়ান্ত রূপ দেখা যায়। ১০ মে (শনিবার) ভোরে ভারতের ভেতরে অন্তত ২৬টি স্থানে হামলা চালায় পাকিস্তান।
পাকিস্তান বলেছে, তারা এই পাল্টা হামলা চালায় ভারতের আগাম ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জবাবে। ভারত নূর খান বিমানঘাঁটিসহ কয়েকটি স্থাপনাকে লক্ষ্যবস্তু করেছিল।
পারমাণবিক যুদ্ধের বার্তা :
ভারতের ওই হামলার এক ঘণ্টার কিছু বেশি সময় পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফ চৌধুরী নিশ্চিত করেন, তাঁদের তিনটি বিমানঘাঁটিতে ভারত হামলা করেছে।
১০ মে কিছু হামলায় ভারত ব্রহ্মস সুপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে বলে জানান এক পাকিস্তানি কর্মকর্তা ও একটি ভারতীয় সূত্র। পাকিস্তানের ধারণা, ব্রহ্মস পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র বহনে সক্ষম, যদিও ভারত বলে এটি শুধু প্রচলিত অস্ত্র বহন করে। ভোর পাঁচটার দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঘোষণা করে, তারা ভারতের বিমানঘাঁটি ও অন্যান্য স্থাপনায় পাল্টা অভিযান চালিয়েছে।
প্রায় দুই ঘণ্টা পর পাকিস্তানি কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের জানান, প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ন্যাশনাল কমান্ড অথরিটির (এনসিএ) বৈঠক আহ্বান করেছেন, যা দেশের পারমাণবিক অস্ত্রের তদারকি করে।
রয়টার্সকে গত মঙ্গলবার পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার বলেন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে, তা অতিরঞ্জিত। তেমন কিছু ঘটেনি, ঘটার কথা নয়। আমরা একটি দায়িত্বশীল দেশ।
তবে ওয়াশিংটনভিত্তিক দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, সংকট কতটা গভীর রূপ নিয়েছে, সেটিই ছিল ন্যাশনাল কমান্ড অথরিটির বৈঠক আহ্বানের বার্তা। বহির্বিশ্বের মধ্যস্থতার জন্য এটি হয়তো একটি পরোক্ষ আহ্বানও ছিল।
এনসিএর বৈঠকের ঘোষণা আসার প্রায় এক ঘণ্টা পর যুক্তরাষ্ট্র জানায়, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। মুনিরকে পাকিস্তানের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাঁকে ও ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে সংঘাত প্রশমনে রাজি করানোর চেষ্টা চালাচ্ছিলেন রুবিও।