টানা বৃষ্টি-পাহাড়ী স্রোত : নগরে জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ মে ২০২৫, ১১:০০:৩২ অপরাহ্ন
সিলেট-সুনামগঞ্জে বন্যা শঙ্কা, বাড়ছে নদ-নদীর পানি
স্টাফ রিপোর্টার : গ্রীষ্মের দাবদাহ নিয়ে সবাই যখন অতিষ্ঠ, তখন সিলেটে শুরু হয়েছে অবিরাম বৃষ্টি। আর এ বৃষ্টিতে সিলেট নগরে দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। অন্যদিকে, বাড়ছে সিলেটের প্রধান নদীগুলোর পানি। শুধু সিলেট নয়, ভারতের মেঘালয় ও আসামে টানা ভারি বর্ষণের পানি উজান থেকে নেমে আসছে। এতে বিভাগের সুনামগঞ্জ ও সিলেট জেলায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বন্যার শঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া বিভাগ।
সিলেট আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ১২ ঘন্টায় সিলেট নগরে ১৮৩ দশমিক ৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এর আগের ১২ ঘন্টায় ( সোমবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৬টা) সিলেটে বৃষ্টি হয়েছে ১৫ মিলিমিটার।
সিলেট আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজীব হোসাইন বলেন, জেলায় আরও বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, সিলেটের নদ-নদীর পানি কিছুটা বেড়েছে। তবে কোনো নদীর পানি এখনো বিপদসীমা অতিক্রম করেনি।
নগরে জলাবদ্ধতা :
সিলেটে সোমবার রাত থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। মঙ্গলবার সকাল থেকে টানা বৃষ্টির কারণে নগরের বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন নগরবাসী। জলাবদ্ধতার কারণে ঘরবাড়ি, সড়ক, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় পানি ঢুকেছে।
টানা অতি বর্ষণের ফলে সিলেট বিভাগের সকল নদ-নদীর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, তবে এখনো কোনো নদী বিপদসীমা অতিক্রম করেনি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরের কাজলশাহ, ওসমানী মেডিকেল কলেজ, আখালিয়া, সুবিদবাজার, চৌহাট্টা সিভিল সার্জন কার্যালয়, মেজরটিলা, ইসলামপুর ও দক্ষিণ সুরমার বঙ্গবীর রোড এলাকায় জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় জমে থাকা পানি নামছে ধীরগতিতে।
সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসেও জলাবদ্ধতা দেখা গেছে। কলেজের প্রবেশপথ থেকে ক্যাম্পাসজুড়ে হাঁটুসমান পানি। শ্রেণিকক্ষে পানি না ঢুকলেও হাসপাতালের আশপাশে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। টানা বৃষ্টিতে শহরের অভ্যন্তরীণ সড়কে যান চলাচল কমেছে। অনেককে ছাতা হাতে প্রয়োজনীয় কাজে বাইরে বের হতে দেখা গেছে।
নগরের কাজলশাহ এলাকার একাধিক বাসিন্দা বলেন, সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি ঘরের সামনে পানি। বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় পানি বাড়ছিল। একপর্যায়ে ঘরে ঢুকে পড়ে। টানা বৃষ্টি হলেই ঘরে পানি ঢোকে। আগেও এমন অবস্থায় দীর্ঘদিন কেটেছে। এবার মৌসুমের শুরুতেই জলাবদ্ধ হয়েছি। প্রতিবছর এই ভোগান্তি পোহাতে হয়।
নগরের মেজরটিলা, দরগা মহল্লা, কুমারপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা বলেন, অল্প বৃষ্টিতেই তাদের এলাকা জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে। জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় ভোগান্তি পোহাতে হয় সবার। বিগত বছরগুলোয় বিষয়টি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে আনা হলেও এর থেকে উত্তরণ হয়নি।
সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, বৃষ্টির পরিমাণ বেশি হওয়ায় বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। পানি দ্রুত নামিয়ে দিতে ড্রেনের ছিদ্র বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আগে যেসব ছিদ্রে নেট বসানো ছিল, সেগুলোও খুলে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তবে সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে। অনেক নালা নর্দমা ও ছড়ায় ময়লা ফেলে পানি চলাচলের পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আবার আগের নিচু এলাকাগুলো আবাসিক এলাকায় রূপান্তর হওয়ায় পানির ধারণক্ষমতা কমে গেছে। এর ফলে জলাবদ্ধতা বাড়ছে।
যা জানালো পাউবো :
সোমবার (১৯ মে) সকাল ৯টা থেকে মঙ্গলবার (২০ মে) সকাল ৯টা পর্যন্ত ২৪ ঘন্টায় সিলেট বিভাগের প্রত্যেকটি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। সুরমা নদীর পানি সিলেটের কানাইঘাট পয়েন্টে ৩০ সেন্টিমিটার, সিলেট পয়েন্টে ৩৭ সেন্টিমিটার, ছাতক পয়েন্টে ৩৬ সেন্টিমিটার, সুনামগঞ্জ পয়েন্টে ৪৪ সেন্টিমিটার, দিরাই পয়েন্টে ৭ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। যাদুকাটা নদীর পানি শক্তিয়ারখোল পয়েন্টে ৯৮ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পায়। কুশিয়ার নদীর পানি সিলেটের জকিগঞ্জের আমলশীদ পয়েন্টে ২৪ সেন্টিমিটার, বিয়ানীবাজারের শেওলা পয়েন্টে ৪১ সেন্টিমিটার, শেরপুর পয়েন্টে ৪২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। মনু নদীর পানি মৌলভীবাজার পয়েন্টে ২২ সেন্টিমিটার, পিয়াইন নদীর পানি সিলেটের গোয়াইনঘাটের জাফলং পয়েন্টে ১০২ সেন্টিমিটার, সারিগোয়াইন নদীর পানি জৈন্তাপুরের সারিঘাট পয়েন্টে ৮৯ সেন্টিমিটার, গোয়াইনঘাট পয়েন্টে ৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে মনু নদীর পানি মনুরেলব্রিজ পয়েন্টে ২২ সেন্টিমিটার এবং ধলাই নদীর পানি কমলগঞ্জ পয়েন্টে ৩২ সেন্টিমিটার কমছে বলেও জানায় পানি উন্নয়ন বোর্ড।
যা জানালো সিলেট আবহাওয়া অফিস :
মঙ্গলবার সকাল ৯টা পর্যন্ত সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার লালাখালে ২১৬ মিলিমিটার, গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলংয়ে ১৩৬ মিলিমিটার, সুনামগঞ্জ শহরে ১৬৫ এবং সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার লাউড়ের গড়ে ১৩৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।
তবে আগামী তিনদিন সুরমা-কুশিয়ারা অববাহিকার সকল নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলেও বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে বলে জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
সিলেটের গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর ও কোম্পানীগঞ্জের বেশ কয়েকটি নিচু এলাকা তলিয়ে গেছে। অতিভারী বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে নদ-নদীর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, তবে এখনো কোনো নদী বিপদসীমা অতিক্রম করেনি।
পাহাড়ী ঢলে প্রবল স্রোত :
জাফলংয়ে হঠাৎ করে পাহাড়ি ঢল নেমে পিয়াইন নদীতে প্রবল স্রোতের সৃষ্টি হয়েছে। ভারতের মেঘালয় থেকে নেমে আসা ঢলটি পিয়াইন নদী হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এতে জাফলংয়ের জিরো পয়েন্টসহ আশপাশের এলাকা দ্রুত প্লাবিত হয়। নদীর পানি প্রবল বেগে প্রবাহিত হওয়ায় শুরু হয়েছে ভয়াবহ ভাঙন। এতে আশপাশের বসতি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো হুমকির মুখে পড়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের বরাতে জানা গেছে, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নদীর পানি বিপদসীমার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।
সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. আনোয়ার উজ জামান বলেন, সিলেটের যে সকল উপজেলা বন্যার আশঙ্কা রয়েছে সেই সকল উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়া আছে, বন্যাপ্রবণ এলাকাগুলোর জন্য নৌকা ও অন্যান্য সরঞ্জাম প্রস্তুত রাখেন। পাশাপাশি সিলেটের প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব প্রস্তুতি রয়েছে। এছাড়া শুকনো খাবার, স্যালাইন রাখা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সব উপজেলা প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
ধেয়ে আসছে বন্যা, প্লাবিত হতে পারে ৪ জেলা :
ময়মনসিংহ বিভাগের শেরপুর ও নেত্রকোনা এবং সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ ও সিলেট জেলায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বন্যার শঙ্কা রয়েছে।
মঙ্গলবার বেসরকারি আবহাওয়াবিষয়ক ওয়েবসাইট আবহাওয়া ডটকমের প্রধান আবহাওয়াবিদ মোস্তফা কামাল পলাশ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন
জানা যায়, ভারতের মেঘালয় ও আসামে টানা ভারি বর্ষণের পানি উজান থেকে নেমে আসছে। পাশাপাশি শেরপুরে গত চার দিনের থেমে থেমে বৃষ্টিপাতের কারণে জেলার নদ-নদীর পানি দ্রুত বাড়ছে। এরই মধ্যে চেল্লাখালী নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে।
মোস্তফা কামাল পলাশ বলেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ময়মনসিংহ বিভাগের শেরপুর ও নেত্রকোনা জেলা এবং সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ ও সিলেট জেলার বিভিন্ন নদীতে পাহাড়ি ঢল শুরুর আশঙ্কা রয়েছে।
এই আবহাওয়াবিদ আরও বলেন, মঙ্গলবার থেকে বুধবার দুপুর ১২টার মধ্যে রংপুর, ময়মনিসংহ ও সিলেট বিভাগের জেলাগুলোর ওপর দিয়ে একনাগাড়ে মাঝারি থেকে ভারি মানের বৃষ্টিপাত অতিক্রমের প্রবল আশঙ্কা করা যাচ্ছে।
সুনামগঞ্জে বাড়ছে পানি :
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, টানা বৃষ্টি ও উজানের পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জে নদ-নদীগুলোতে পানি বাড়তে শুরু করেছে। একই সাথে জেলার সবগুলো হাওরের বাড়ছে পানি। গত ২৪ ঘণ্টায় সুরমা নদীর পানি বেড়েছে ৫ দশমিক ১৯ সেন্টিমিটার। এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জে ১৬৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের রেকর্ড করা হয়েছে।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, সুনামগঞ্জ পৌর শহরের সুরমা নদীর ষোলঘর পয়েন্টে গত ২৪ ঘন্টায় ৫.১৯ সেন্টিমিটার পানি বেড়েছে। এই স্থানে নদীটির পানি বিপদসীমার ২ দশমিক ৬ মিটার নিচে অবস্থান করছে। এ ছাড়া সুনামগঞ্জের জাদুকাটা, পাটলাই, কুশিয়ারা, নলজুর, চেলা, চলতি, রক্তি, বৌলাইসহ সব নদীর পানি বেড়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাওরে পানি প্রবেশ করে ধীরে ধীরে পানিতে টইটম্বুর হচ্ছে। বৃষ্টি ও উজানের ঢল অব্যাহত থাকলে আকষ্মিক বন্যা হতে পারে। এছাড়া, আগামী ৩ দিন সুনামগঞ্জে ভারি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে বলেও জানা যায়।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন হাওলাদার বলেন, বৃষ্টি ও উজান থেকে নামা পাহাড়ি ঢলে জেলার নদ-নদীর পানি বাড়ছে। আগামী ৭২ ঘণ্টা বৃষ্টির পূর্বাভাস আছে।