এনসিপি-বিএনপি বাকযুদ্ধ : রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব কি বাড়ছে?
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ মে ২০২৫, ১২:৩০:৩১ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের মেয়র পদ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের অবস্থানকে ঘিরে কমিশনের সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি। শেখ হাসিনার সরকার পতন ও বিচারের দাবিতে নতুন গঠিত রাজনৈতিক দল এনসিপি ও বিএনপি একই সময় মাঠে আন্দোলনে থাকলেও এই ঘোষণায়ই মূলত দল দু’টির মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এসেছে। এ নিয়ে প্রতিবদেন করেছে বিবিসি।
প্রায় এক সপ্তাহ ধরে ইশরাক হোসেনকে মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানোর দাবিতে নগর ভবনের সামনে আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন তার সমর্থকরা। এরই মধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ মঙ্গলবার বিবিসিকে জানিয়েছেন, প্রয়োজনে এই আন্দোলনে দলগতভাবে সমর্থন দেয়া হবে।
অন্যদিকে এনসিপি নেতাদের ঘনিষ্ঠ স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের পদত্যাগও দাবি করেন ইশরাক সমর্থকরা।
পরে মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে রাজধানীর বাংলামোটরে দলের অস্থায়ী কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাকে ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ অভিহিত করে নিজেদের অবস্থানের জানান দেয় এনসিপি।
লিখিত এক বক্তব্যে দলটি বলে, ২০২০ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অবৈধ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বর্তমানে জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকাই দায়ী বলে আমরা মনে করি।
নির্বাচন কমিশন এর আগেও নিরপেক্ষ আচরণ বজায় রাখার পরিবর্তে এমন সব বক্তব্য দিয়েছে যার সঙ্গে “একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের অবস্থানের সাযুজ্য রয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন দলটির নেতা আখতার হোসেন।
ওই মামলার বিবাদী হওয়া সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন আইনি লড়াইয়ে যায়নি, ফলে একতরফা রায় দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ দলটির। এমনকি নির্বাচন কমিশন রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে না গিয়ে মামলার বাদীকে বিশেষ সুবিধা দিয়েছে বলেও মনে করছে জাতীয় নাগরিক পার্টি।
এরই প্রেক্ষাপটে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব আমলে নিয়ে অবিলম্বে কমিশন পুনর্গঠনের দাবিতেই এনসিপির আজ বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে। আগে ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচন নাকি জাতীয় সংসদ নির্বাচন’ এই ইস্যুতেও দুই দলের বিরোধী অবস্থান দেখা গেছে। সংস্কার প্রশ্নেও প্রকাশ্যে পরস্পর-বিরোধী বক্তব্য দিতে দেখা গেছে দুই দলের নেতাদের।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন ইশরাক হোসেনের মেয়র পদের ইস্যুটিকে জাতীয় ইস্যুতে পরিণত করে বিএনপি শো-ডাউনের রাজনীতি করছে। কারণ অন্তর্র্বতী সরকারের কাছে বিএনপি বারবারই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ দাবি করে আসছে। তবে ‘ডিসেম্বর থেকে জুন’ এই টাইমলাইনই বেঁধে দিচ্ছে সরকার। ফলে ইশরাকের ইস্যুকে কেন্দ্র করে যা ঘটছে সেটিকে মূলত “বিএনপির সাথে এনসিপির শক্তির পরীক্ষা” বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
ইসি বিএনপির ‘দলীয় কার্যালয়’- অভিযোগ এনসিপির :
নির্বাচন কমিশনের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকার অভিযোগ তুলে মঙ্গলবার রাতে এনসিপি ঘোষিত ইসি ঘেরাও কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছিল। সেখানে কয়েক স্তরে ব্যারিকেড দিয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মোতায়েন করা হয় পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য।
ইসির সামনে বিক্ষোভ সমাবেশে নির্বাচন কমিশনকে “বিএনপির দলীয় আখড়া” বলে অভিহিত করেন এনসিপি নেতা নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। পাটওয়ারী বলেন, “এই যে ইসি গঠন করা হয়েছে এটা কোনো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এখন অ্যাকটিভ করে না। এটা বিএনপির একটি দলীয় কার্যালয় হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। এটা বিএনপির মুখপাত্র হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে।
বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদের বিরুদ্ধে “ভারতের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী মুজিববাদী সংবিধান রাখতে চায়” বলে অভিযোগ তোলেন মি. পাটওয়ারী।পাটওয়ারী বলেন, বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনই হবে। আমরা যতদিন বেঁচে আছি এই ইসি পুনর্গঠন করেই ছাড়বো। ইসি পুনর্গঠন না হলে বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন জাতীয় নাগরিক পার্টি করতে দেবে না বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন তিনি।
এনসিপির দাবিতেই আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হয়েছে উল্লেখ করে মি. পাটওয়ারী বলেন, কিন্তু আওয়ামী লীগের এই ইলেকশন কমিশন… সংবিধান এখনো নিষিদ্ধ হয় নাই। আমরা সংবিধান পোড়ানোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবো। বাংলাদেশে কোনো মুজিবীয় সংবিধান থাকবে না। জুলাই ঘোষণাপত্র পেতে এনসিপি এখনো দিনক্ষণ গুনছে বলে মন্তব্য করেন পাটওয়ারী।
এর আগে আইন উপদেষ্টা একবার এই ঘোষণাপত্র দেয়ার ঘোষণা দিলেও তা হয়নি। তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। দ্বিতীয়বারও বিশ্বাস করেছেন উল্লেখ করে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, এবার যদি হেরফের হয় আসিফ নজরুল বাংলাদেশে থাকবে কিনা আমি জানি না।
‘বিএনপি ও এনসিপির শক্তির পরীক্ষা’ :
মেয়র নির্বাচনের পাঁচ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর ‘মীমাংসিত ইস্যু’ নিয়ে বিএনপির এই মাঠে নামাকে ‘শো-ডাউনের রাজনীতি’ বলে অভিহিত করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ।
কারণ হিসেবে তিনি মনে করছেন নির্বাচন কমিশনের প্রজ্ঞাপন জারির পরই এই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। তিনি বিবিসিকে বলেন, নির্বাচনের পর তো পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে। তখন তারা কারচুপির অভিযোগ এনে প্রার্থিতাই প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। অর্থাৎ সেক্ষেত্রে বলা যায় যে নির্বাচনটাই তাদের (বিএনপি) কাছে ভুয়া। অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের ব্যাপারে কালক্ষেপণ করছে এই মনোভাব থেকেই বিএনপির এই রাজনৈতিক অবস্থান বলে মনে করছেন মহিউদ্দিন আহমদ।
তিনি বলেন, বিএনপি এক ধরনের শো-ডাউনের রাজনীতি করছে। তারা মনে করছে সরকার নির্বাচনের ব্যাপারে কালক্ষেপণ করছে। বিএনপির ধারণা নির্বাচন হলে তারাই তো হবে। সুতরাং এখন তাদের পথের কাঁটা হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিশেষ করে তাদের কিছু কিছু সিদ্ধান্তের কারণে বিএনপি মনক্ষুন্ন।
নির্বাচন কমিশনে ‘বিএনপিপন্থি লোকেরা’ রয়েছে এমন গুঞ্জন প্রচলিত রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। নইলে হঠাৎ করে তড়িঘড়ি করে ইশরাক হোসেনের জন্য এরকম প্রজ্ঞাপন জারি করার তো কোনো দরকার ছিল না। আরও রয়ে সয়ে দিতে পারতো।
ইশরাক হোসেনকে মেয়র ঘোষণার ইস্যুকে কেন্দ্র করে দুই দলই নিজেদের শক্তি পরীক্ষার জন্য মাঠে নেমেছে বলে মনে করেন এই বিশ্লেষক।৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পরে বিএনপির রাজনীতিতে ‘জুলাই স্পিরিটের’ আলোকে কোনো পরিবর্তন না আসাই এনসিপির সাথে তাদের রাজনৈতিক বিরোধ বলে মনে করছেন। আর বিভিন্ন সংস্কার প্রশ্নে এনসিপি ও বিএনপির সুস্পষ্ট রাজনৈতিক বিরোধও রয়েছে বলে মনে করেন তিনি। মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, বিএনপির রাজনীতিতে তো কোনো পরিবর্তন আসেনি। পাঁচই অগাস্টের কোনো ছোঁয়া তাদের লাগেনি। এখানেই এনসিপির সঙ্গে তাদের রাজনৈতিক বিরোধ। এক্ষেত্রে সরকারের ‘ব্যালেন্সড’ অবস্থান কতদিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখবে সে বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করেন তিনি।