সাফল্য-ব্যর্থতার মিশেলে অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ আগস্ট ২০২৫, ১২:৩৫:৪৫ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট: গতকাল ৮ আগস্ট বছর পূর্ণ করলো অন্তর্বতী সরকার। গণ-অভ্যুত্থানের হাজারো শহীদের রক্তের সৌধের উপর নির্মিত সরকার এই এক বছর কেমন কেটেছে-তা নিয়ে চলছে আলোচনা বিশ্লেষণ। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তকালীন সরকারের এক বছরের কেটেছে সাফল্য-ব্যর্থতার মিশেলেই।
অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় সফলতা কী এই প্রশ্নে অর্থনীতিতে ব্যাংক, বাজার, রিজার্ভসহ সার্বিক পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য সরকার কৃতিত্ব পাচ্ছে। এ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করছেন অর্থনীতিবিদরা।
জুলা গণঅভ্যুত্থান দিবসে রাজনৈতিক দলের কয়েকজন নেতাকে পাশে রেখে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা সেদিনই মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচনের সময় ঘোষণা করেছেন। আর রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ চূড়ান্ত করার কাজ চলছে। এগিয়ে চলছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের দমন-পীড়নের বিচারের কাজও।
এক বছরের পথ চলায় রাজনৈতিক পরিসরে সবচেয়ে আলোচিত এসব বিষয়ে যে অগ্রগতি হয়েছে তাকে অন্তর্বর্তী সরকারের সফলতা হিসেবে দেখা হচ্ছে। সরকারে তরফে ১২টি ‘অর্জনের’ কথা তুলে ধরা হয়েছে ইতোমধ্যে।
তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির, মব ভায়োলেন্স, মৌলিক সংস্কার এমনকি বিচার প্রক্রিয়ার কিছু বিষয়ে সরকারের ভূমিকার নানা সমালোচনা করছেন পর্যবেক্ষক এবং বিশ্লেষকরা।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর আন্দোলনকারী সকল পক্ষের সমর্থনে অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে ৮ আগস্টে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকারের সামনে সংস্কার, বিচার এবং নির্বাচন অনুষ্ঠান এই তিনটি বড় দায়িত্ব ছিল। এছাড়া ভঙ্গুর অবস্থা থেকে দেশের অর্থনীতিকে সামাল দেওয়ার চ্যালেঞ্জ ছিল সরকারের সামনে। যেটিতে অনেকাংশেই সফল বলা যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ এখন ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।
অর্থনীতির স্থিতিশীলতা :
অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনা এবং বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তার প্রশংসা রয়েছে। তবে বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নয়ন না হওয়ায় দুর্বলতার কথাও সামনে আনছেন অর্থনীতিবিদরা।
সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে এ বছরের জুন মাসে দেশে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি কমে ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশে নেমেছে, যা গত ৩৫ মাসে সর্বনিম্ন। ৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য রয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ছিল তাঁর সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
সরকারের প্রতি প্রবাসী বাংলাদেশিদের গভীর আস্থার ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে বলে জানান ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি উল্লেখ করেন, গত অর্থবছরে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেকর্ড ৩ হাজার ৩৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, যা রপ্তানি আয়কে প্রায় ৯ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে টাকার মান শক্তিশালী হয়েছে। বহু বছর পর টাকার মূল্য ডলারের বিপরীতে বাড়ছে।
সরকারের এক বছরের মূল্যায়ন করে অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বিবিসিকে বলেন, যে অর্থনীতি এ সরকার উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিল সেটা তো খুবই জটিল অবস্থার ভেতরে ছিল। অর্থনীতিতে সামষ্টিক স্থিতিশীলতার একটা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে ছিল সরকারের পক্ষ থেকে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা, টাকার পতন আটকানো, সুদের হার একটা অবস্থায় রাখা, বাজেট ঘাটতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা ইত্যাদি। কাজের ভেতরে সাফল্য এসেছে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নাই।
তবে অর্থনীতির এই সাফল্যটা মূলত হয়েছে বাইরের খাতে বা এক্সটার্নাল সেক্টরে। অর্থাৎ রেমিটেন্স বেড়েছে, রপ্তানি চালু আছে, আমদানি কম হওয়ার ফলে বৈদেশিক লেনদেনে একটা ভারসাম্য এসেছে এবং সরকার অনেক পুরোনো বিদেশি ঋণ শোধ করেছে। রাষ্ট্রীয় লুটপাট বন্ধ হয়েছে। এই সময়কালে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ সে অর্থে কমেনি বলেও মনে করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
তবে তার দৃষ্টিতে কর আহরণ বা আরও কার্যকরভাবে সরকারের বিনিয়োগ বা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে অনেক বড় দুর্বলতা রয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় দুর্বলতা রয়ে গেছে আমরা ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ চালু করতে পারি নাই। যে কর্মসংস্থানের আকাঙ্খা থেকে ছাত্র গণঅভ্যুত্থান হলো সেই কর্মসংস্থানের জায়গাটা দুর্বল রয়ে গেল।
অর্থনীতিতে সরকারের সমস্যার জায়গা তুলে ধরে তিনি বলছেন, সরকার অনেক সংস্কারের কথা বলে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো মধ্যমেয়াদী নীতিকাঠামো দেওয়া হয়নি অর্থনীতির।
বিচার ও সংস্কার
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে বড় দায়িত্ব ছিল ‘জুলাই হত্যা’র বিচার এবং প্রশাসন থেকে শুরু করে নির্বাচন, দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশ বাহিনীসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে মৌলিক কিছু সংস্কার করা।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর একাধিক সংস্কার কমিশন গঠন করে। যার মধ্যে রয়েছে নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন, বিচারব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন–সংক্রান্ত সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন, শ্রমিক অধিকার সংস্কার কমিশন ও নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন। এসব কমিশন তাদের সুপারিশমালা জমা দিয়েছে। সরকার অনেক ক্ষেত্রেই সুপারিশ বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বিবিসিকে বলেন, বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন তিনটি ক্ষেত্রেই কিছু ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে।
জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করতে সরকার একটি রূপরেখা দিয়েছে। তবে বিচার ও সংস্কার ইস্যুতে অগ্রগতির বেলায় সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
গত এক বছরে বিচারব্যবস্থা প্রসঙ্গে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বিচার প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ, এ নিয়ে বিতর্কের কোনও সুযোগ নাই। কারণ হিসেবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ঢালাও মামলার ব্যাপারে শুরু থেকেই তাদের উদ্বেগ রয়েছে। এটি কোনো দেশেই বিচার প্রক্রিয়ার জন্য সুষ্ঠু না বলে তারা মনে করেন।
এ বিষয়ে সরকারের একটা অবস্থান আছে যে মামলাগুলো সরকার করে না, সে কথা উল্লেখ করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এটা ঠিক। কিন্তু এটাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিকারের উপায় তো সরকারকেই বের করতে হবে। সেদিকে আমরা তেমন কিছু দেখি না।
কতটুকু বিচার, কতটুকু প্রতিশোধ এই প্রশ্নটা ওঠা খুবই যৌক্তিক, যেভাবে চলছে। অন্যদিক থেকে আবার বিচারকেন্দ্রিক অনিয়ম-দুর্নীতি–– যেমন মামলা বাণিজ্য, গ্রেফতার বাণিজ্য, জামিন বাণিজ্য এই বিষয়গুলো মোটামুটি এক ধরনের স্বাভাবিকতায় রূপান্তর করা হয়েছে।
অভ্যুত্থানপরবর্তী বর্তমান প্রশাসনেও দলীয়করণ চলছে বলে সমালোচনা আছে। বলা হচ্ছে, এক দলের জায়গায় অন্য দল এসে বসেছে।
তিনি বলছেন, দ্বিতীয় পর্যায়ে যে পাঁচটি সংস্কার কমিশন, সে কমিশনগুলো যথাযথ সময়ে রিপোর্ট দিয়েছে। রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে আশু করণীয় প্রস্তাবনাগুলো জমা দিয়েছে সরকারের কাছে। কিন্তু সেগুলো নিয়ে কোনো আলোচনা নাই, কোনো অগ্রগতি নাই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে পিক অ্যান্ড চুজ।
আইন শৃঙ্খলার অবনতি ও মব ভায়োলেন্স :
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তার মধ্যেই দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এরপর বাহিনীগুলোর পুনর্গঠনের কাজে হাত দিলেও পরিস্থিতির উন্নয়নে খুব একটা সফলতা আসেনি বলে মনে করা হয়।রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় চাঁদাবাজি পুরোদমে ফিরে এসেছে। চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। খুনোখুনি, ধর্ষণ, ছিনতাইয়ের ঘটনা প্রায়ই আলোড়ন তুলছে।
সচিবালয়ের মতো রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নিরাপদ জায়গায় দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনকারীদের জোর করে ঢুকে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। হয়েছে ভাঙচুরের ঘটনাও।এ সরকার ‘মব’ ঠেকাতেও ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। মবের মাধ্যমে একটি শ্রেণির আইন হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটেই চলছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের ভূমিকা রাখতে পারছে না বলে বিভিন্ন মহল থেকেই বলা হচ্ছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে তাদের অর্জন আছে।
গত এক বছরে বাংলাদেশে মব সংস্কৃতি এবং এক্ষেত্রে সরকারের অবস্থান নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীন।
তিনি বলেন, সরকার বা সেনবাহিনী বলছে যে মব ভায়োলেন্স টলারেট করবে না। কিন্তু কার্যত আমরা দেখতে পাচ্ছি যে মবের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না এবং আমরা দেখেছি যে সরকার বিভিন্ন সময় একে বৈধতা দিয়েছে বলে মনে হয়েছে। যেমন অপারেশন ডেভিল, তার মাধ্যমে মব বৈধতা পেয়েছে। তারপরে তৌহিদি জনতা। তারপর আমরা দেখেছে প্রেসসচিব বলেছেন যে এটা একটা প্রেসার গ্রুপ। এই যে বিভিন্নভাবে মবকে বৈধতা দেওয়া, এইটাকে আমি মনে করি সরকারের জন্য একটা নেগেটিভ পয়েন্ট হিসেবে কাজ করেছে। মব একটা আতঙ্কের জায়গা তৈরির ক্ষেত্রেও বিশেষ ভূমিকা রাখছে বলে আমি মনে করি।