ইসলামপন্থীদের নিয়ে বিএনপির মনোভাব
প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ৬:২৭:৪০ অপরাহ্ন
সাদিক সিকানদার
‘রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থীদের উত্থান দেখছি, আমি উদ্বিগ্ন’ ২৯ জুলাই, ২০২৫ জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো’য় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সাক্ষাৎকারের শিরোনাম ছিল এটি। এর আগে একবার তিনি বলেছিলেন, “বিএনপি শরীয়া আইনে বিশ্বাস করে না”। ‘এই দেশ কোনো চরমপন্থা বা মৌলবাদের অভয়ারণ্যে যেন কোনোদিন পরিণত হতে না পারে, সেটিই আমাদের প্রত্যাশা, সেটিই আমাদের লক্ষ্য।” ১৭ আগস্ট ২০২৫ বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবে এক মতবিনিময় সভায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঠিক এই ভাষায় নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেন। বিএনপির সর্বোচ্চ দুই শীর্ষ নেতার বক্তব্য থেকে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় বিএনপি ইসলামপন্থীদের ব্যাপারে এখন কী মনোভাব পোষণ করছে? ফ্যাসিবাদী দল আওয়ামী লীগ ও তার বামপন্থী মিত্ররা ইসলামী দলগুলোর ব্যাপারে যে মনোভাব পোষণ করত জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি ধীরে ধীরে সেই মনোভাব পোষণ করছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। বিগত বছরগুলোতে আওয়ামী লীগ ও তাদের বামপন্থী মিত্ররা যে কথাগুলো বলে আসছিল এখন বিএনপির শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে স্থানীয় নেতারাও সেই কথাগুলো বলছেন এবং আওয়ামীলীগ যা করত বিএনপি তাই করে যাচ্ছে বলে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।
২০০৬ সালে শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হকের দল খেলাফত মজলিসের সাথে আওয়ামী লীগ ৫ দফা চুক্তি করে, সেই চুক্তিতে ব্লাসফেমি আইন প্রণয়ন, কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা এবং ফতোয়াকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়ার মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু অল্প সময়ের ব্যবধানে আওয়ামী লীগ সেই চুক্তিকে ছুড়ে ফেলে এমনকি শায়খুল হাদীসপুত্র মাওলানা মামুনুল হকের উপর নির্মম অত্যাচার চালায়। শায়খুল হাদীসের প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা থেকে তার সন্তানদের বের করে দেওয়ার মতো কাজ শেখ হাসিনার আমলেই হয়েছিল। অনুরূপভাবে বিগত ২১ জানুয়ারি ২০২৫ সালে চরমোনাইর পীরের সাথে জামায়াত আমীরের সাক্ষাতের পরপরই ২৭ জানুয়ারি ২০২৫, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং জনাব বরকত উল্লা বুলু হাজির হন পল্টনস্থ ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের অফিসে। পীরসাহেব হুজুর সেদিন ৫ কল্লির টুপি পরিয়ে দিয়েছিলেন মির্জা আলমগীর সাহেবের মাথায়। সেদিন দশ বিষয়ে বিএনপি ও ইসলামী আন্দোলন ঐকমত্যে এসেছিল এবং যৌথ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জাতির সামনে ঘোষণা করেছিলেন মির্জা ফখরুল নিজেই। যার একটি ছিল- বিএনপি ইসলামী শরিয়াহবিরোধী কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না, অথচ সেই ফখরুল ইসলাম আলমগীর এখন বলেন তিনি শরীয়া আইন বিশ্বাসই করেন না। জোটে পাওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় মির্জা আব্বাস, শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এনির মতো সিনিয়র নেতারা চরমোনাই পীর সাহেবকে নিয়ে যা বলছেন তা আওয়ামী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। আওয়ামী লীগ এবং তাদের বামপন্থী মিত্ররা ইসলামপন্থীদের মৌলবাদ, ধর্মান্ধ, প্রতিক্রিয়াশীল, উগ্রবাদ বলে প্রচার করতো। আলেম-উলামাকে ঢালাওভাবে জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করত, মাদরাসাগুলোকে জঙ্গি প্রজনন কেন্দ্র বলে প্রচার করত, কুরআন, হাদীস, এমনকি ইসলামী বইকে জিহাদী বই বলে জব্ধ করে জাতীয় প্রচার মাধ্যমে উপস্থাপন করত, কুরআন শিক্ষার আসর থেকে উঠিয়ে নিয়ে নাশকতার চেষ্টাকালে গ্রেপ্তার বলে মামলা দিত। তাদের মতলব ছিল পশ্চিমাদের এই ভয় দেখানো যে, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান হয়ে যাচ্ছে। তারা বুঝাতে চাইতো, তারাই পারবে এদেরকে দমিয়ে রাখতে। জনাব তারেক রহমান সেই আওয়ামী গুটির চাল শুরু করেছেন। তিনি বলেছেন, “এই দেশ কোনো চরমপন্থা বা মৌলবাদের অভয়ারণ্যে যেন কোনোদিন পরিণত হতে না পারে সেটিই আমাদের প্রত্যাশা, সেটিই আমাদের লক্ষ্য”। তিনিও আওয়ামী স্টাইলে পশ্চিমাদের বুঝাতে চাইছেন মৌলবাদ, উগ্রবাদ ঠেকানো তার অন্যতম লক্ষ্য। ইসলামের সাথে উগ্রবাদের কোনো সম্পর্ক নাই। এদেশের মূলধারার আলেম-উলামা দীর্ঘ দিন ধরে উগ্রবাদের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছেন। কাজেই ইসলামের সাথে উগ্রবাদকে গুলিয়ে ফেলার ফল খুবই অপরিণামদর্শী হবে।
ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ ও তাদের বামপন্থী মিত্রদের আরেকটা চরিত্র ছিল তারা কিছু ইসলামী দলকে ঘায়েল এবং কিছু ইসলামী দলকে বগলবন্দী করে রাখত। কিছু দলকে স্বমূলে উৎখাত এবং কিছু দলকে আশীর্বাদ করত। তারা জামায়াত, হেফাজত, খেলাফত মজলিস ও জমিয়তের একাংশের উপর ভয়াবহ জুলুম চালিয়েছে। অন্যদিকে তরিকত ফেডারেশন, ইসলামিক ফ্রন্ট, জাকের পার্টি, সুপ্রিম পার্টি, আল ইসলাহসহ অনেক ইসলামী দলের সাথে বিভিন্নভাবে জোট ও সমঝোতায় ছিল। প্রথম আলো’য় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত ৭০ টি ইসলামী দলের মধ্যে ৬৩ টি ছিল আওয়ামী লীগের সাথে। ঠিক একই চরিত্র লক্ষণীয় হচ্ছে বিএনপির মধ্যে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দক্ষিণপন্থীদের উত্থানে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও তার দল ইসলামপন্থী কিছু দলকে সাথে রাখার জন্য মরিয়া হয়ে কাজ করছেন। তিনি চরমোনাইর পীরের দল ইসলামী আন্দোলনের অফিসে গিয়ে ধর্ণা দিয়ে ব্যর্থ হয়ে এসেছেন। সালাহ উদ্দীন সাহেব হেফাজতের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। খেলাফত মজলিস, ইসলামী ঐক্যজোটের সাথে বসেছেন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সাথে বিএনপির বোঝাপড়া অনেকদূর এগিয়েছে, একে অপরের দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন, অভিন্ন ভাষার কথা বলছেন, এমনকি আসন ছাড়ের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। প্রশ্ন হলো, জমিয়ত কি তাহলে দক্ষিণপন্থী দল নয়? বাংলাদেশ পৃথিবীর বৃহত্তর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি দেশ। বিএনপি এদেশের বৃহত্তম ও জনপ্রিয় একটি দল। দেশের মানুষ দলটিকে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী দল হিসেবে জানে এবং বারবার ক্ষমতায় বসিয়েছে। এখন বিএনপি যদি তার আদর্শ ও কর্ম কৌশলে পরিবর্ত আনে, মৌলবাদ তকমা দিয়ে ইসলামকে ঘায়েল করতে চায়, পশ্চিমাদের মত উগ্রবাদ দমনের নামে ইসলাম দমিয়ে রাখার লক্ষ্য স্থির করে কাজ করে, শরীয়াহ আইনকে জনমনে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়, তাদের কর্মকৌশল যদি ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের সাথে হুবহু মিলে যায় যায় তাহলে তাহলে এদেশের ইসলাম প্রিয় মানুষকে বিএনপিকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।