জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও রাজনৈতিক দলে গণতন্ত্রচর্চাসহ আট দফা সুপারিশ
প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ নভেম্বর ২০২৫, ৯:৪৭:৪৬ অপরাহ্ন

জালালাবাদ রিপোর্ট : আগামী জাতীয় নির্বাচনকে শান্তিপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য করার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) আট দফা সুপারিশ করেছে। বুধবার ওয়াশিংটন থেকে প্রকাশিত আইআরআইয়ের এক প্রতিবেদনে এই সুপারিশ করা হয়েছে।
আরআইআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বেশ কিছু প্রশংসনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে। এসব প্রচেষ্টার পরও প্রাক্-নির্বাচনী পরিবেশ এখনো নাজুক। রাজনৈতিক সহিংসতার বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা, স্থানীয় প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন এবং নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি অবিশ্বাসের প্রবণতা এখনো রয়েছে। জনগণের আস্থা বজায় রাখতে ধারাবাহিক যোগাযোগ এবং রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজের অংশীদারদের সঙ্গে নিয়মিত সংলাপ অপরিহার্য।
আন্তর্জাতিক নীতি ও নির্বাচনী বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত একটি প্রাক্-নির্বাচনী মূল্যায়ন মিশন বাংলাদেশে পাঠায় আইআরআই। বাংলাদেশে গত ২০ থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত তাঁরা পরিস্থিতি মূল্যায়ন করেন। নির্বাচনী পরিবেশ ও গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণের সম্ভাবনা মূল্যায়নের উদ্দেশ্যে তারা নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্মকর্তা এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা মোট ২১টি বৈঠকে ৫৯ জন অংশগ্রহণকারীর সঙ্গে আলোচনা করেন।
রাজনৈতিক পরিসরের বিবর্তন :
আইআরআই বাংলাদেশের প্রাক্-নির্বাচনী পরিবেশ মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছে, তরুণদের নেতৃত্বাধীন দলের আবির্ভাব ও প্রবাসী বাংলাদেশিসহ প্রথমবারের মতো বিপুলসংখ্যক ভোটারের অংশগ্রহণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে সম্ভাব্য এক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এ পরিস্থিতি দেশের গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণে তাঁদের ধারাবাহিক ভূমিকারও আভাস আছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সম্ভাব্য জাতীয় নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বিশ্বাসযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সংস্কার আন্দোলনের অঙ্গীকার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে কি না, তা আগামী কয়েক মাসে স্পষ্ট হবে। নিরপেক্ষতা বজায় রাখা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংস্কার কর্মসূচির টেকসই বাস্তবায়নের ওপর অন্তর্র্বতী সরকারের সাফল্য নির্ভর করছে।
এতে বলা হয়, জুলাই জাতীয় সনদ গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণের জন্য একটি নীলনকশা তুলে ধরেছে। তবে এর বাস্তবায়ন অনেকাংশেই পরবর্তী সংসদের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। ধারাবাহিক সংলাপ, স্বচ্ছ নির্বাচন প্রশাসন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর বিশ্বাসযোগ্য অংশগ্রহণের মাধ্যমে রূপান্তর প্রক্রিয়ার প্রতি জন আস্থা জোরদার করা অপরিহার্য।
নির্বাচন সামনে রেখে আট সুপারিশ :
নির্বাচন কমিশন, সরকারি প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল এবং অন্যান্য নির্বাচনী অংশীজনের বিবেচনার জন্য আইআরআই মিশন আটটি সুপারিশ দিয়েছে। প্রাক্-নির্বাচনী সময়ে এবং তারপরও এসব ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা গেলে তা বিশ্বাসযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজনে সহায়তা করবে।
জুলাই সনদের বাস্তবায়ন
রাজনৈতিক দলগুলোকে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে-যাতে সময়সীমা স্পষ্ট করা, বিতর্কিত বিষয়গুলোর সমাধান এবং গণতান্ত্রিক সংস্কার বজায় রাখার প্রকাশ্য অঙ্গীকার অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে জুলাই সনদ প্রশ্নে গণভোট আয়োজনের জন্য সুস্পষ্ট ও আইনি কাঠামো নির্ধারণ করতে হবে।গণভোটের সময় ও ক্রম নির্ধারণে স্বচ্ছ আইনি ব্যাখ্যা ও ব্যাপক রাজনৈতিক ঐকমত্যই নির্দেশক হওয়া উচিত। গণভোটের উদ্দেশ্য, প্রক্রিয়া ও প্রভাব সম্পর্কে জনগণকে স্পষ্টভাবে জানাতে হবে, যা আস্থা বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য।
নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও গণতান্ত্রিক সংস্কারকে সহায়তা করা
জুলাই সনদ সম্পর্কে জনগণের বোঝাপড়া নিশ্চিত করতে শক্তিশালী নাগরিক শিক্ষা উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি। নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রস্তাবিত সংস্কার, বিশেষত সাংবিধানিক পরিবর্তন ও নির্বাচনী প্রক্রিয়া সম্পর্কে দেশব্যাপী ভোটারদের সচেতনতা কার্যক্রমকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এসব শিক্ষা কার্যক্রমকে সর্বজনীন, সহজলভ্য এবং নতুন ভোটার, তরুণ, নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে।
নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ উৎসাহিত করা
রাজনীতির সব ক্ষেত্রেই নারীরা এখন পর্যাপ্ত প্রতিনিধিত্ব পাচ্ছেন না। রাজনৈতিক দলগুলোকে নারীর অধিকার সুরক্ষা, নেতৃত্ব বিকাশ, প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন এবং সংরক্ষিত আসনের বাইরেও অংশগ্রহণে উৎসাহ দিতে হবে।
প্রার্থী বাছাইয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা
রাজনৈতিক দলগুলোকে অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক চর্চা জোরদার করতে হবে, যাতে প্রার্থী মনোনয়ন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ, পদ্ধতিগত ও জবরদস্তি বা পক্ষপাতমুক্ত থাকে।
নিরাপত্তা পরিকল্পনার সমন্বয়
প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্বাচন কমিশনকে সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় বাড়িয়ে স্থানীয় উত্তেজনা প্রশমনে ও নির্বাচন-সংক্রান্ত সহিংসতা প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। যৌথ পরিকল্পনা, স্বচ্ছ যোগাযোগ প্রক্রিয়া এবং সমন্বিত সাড়াদান প্রক্রিয়া জননিরাপত্তা ও ভোটারের আস্থা বজায় রাখতে অপরিহার্য।
নাগরিক নির্বাচন পর্যবেক্ষণে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি
সুপারিশে বলা হয়, নির্বাচন কমিশনকে নাগরিক পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলোর স্বীকৃতির জন্য স্পষ্ট ও সহজলভ্য মানদণ্ড ঠিক করতে হবে-যাতে যোগ্যতা, মূল্যায়ন পদ্ধতি ও পর্যালোচনার বিষয়গুলো স্পষ্ট থাকে। কোনো আবেদন প্রত্যাখ্যানের ক্ষেত্রে লিখিত ব্যাখ্যা দিতে হবে, যাতে জবাবদিহি ও আস্থা বৃদ্ধি পায়।স্বীকৃত পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোকে নিরপেক্ষতা ও অরাজনৈতিক অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তাদের কাজ বিশ্বাসযোগ্য হয়।
রাজনৈতিক অর্থায়নে স্বচ্ছতা
প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্বাচন কমিশনকে আইন সংশোধনের মাধ্যমে রাজনৈতিক তহবিল সংগ্রহ ও ব্যয়ের তথ্য জনগণের জন্য উন্মুক্ত করার প্রস্তাব দিতে হবে। এতে নাগরিক, গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজ আর্থিক প্রবাহ পর্যবেক্ষণ ও নির্বাচনী বিধি যাচাই করতে পারবে।
অবাধ, স্বাধীন ও বিশ্বাসযোগ্য তথ্য পরিবেশন নিশ্চিত করা
প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়, গণমাধ্যমকে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে সংবাদ প্রচার করতে হবে। সম্পাদকীয় স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে এবং সাংবাদিকদের রাজনৈতিক বা আর্থিক চাপমুক্তভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে।







