সিলেটের পর্যটন খাতে ঈদে ক্ষতি আড়াইশ কোটি টাকা
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ জুন ২০২৪, ২:২৫:১৯ অপরাহ্ন
এমজেএইচ জামিল : পাহাড়, ঝর্ণা, নদী, হাওর, অরণ্য, চা বাগান কিংবা জলারবনের নৈসর্গিক লীলাভূমি সিলেট। হযরত শাহজালাল (র.) ও শাহপরান (র.) সহ ৩৬০ আউলিয়ার স্মৃতি বিজড়িত সিলেটকে বলা হয় দেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী। প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে সিলেটের পরিচিতি বিশ^জুড়ে।
গেল ঈদুল ফিতরের ছুটিতে সিলেটে পর্যটকের ঢল নামে। এসময় পর্যটন খাতে ফিরে আসে প্রাণচাঞ্চল্য। হাসি ফুটে পর্যটন সংশ্লিষ্টদের মুখে। ঈদুল আযহা ঘিরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলেন তারা। কিন্তু আকস্মিক বন্যায় লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় সিলেটের পর্যটন খাত। এদে শুধু ঈদুল আযহা উপলক্ষে এই খাতে ক্ষতি হয়েছে কমপক্ষে আড়াইশ কোটি টাকা।
এদিকে শর্তসাপেক্ষে সিলেটের সাদাপথর, জাফলং, রাতারগুল, বিছনাকান্দি, লালাখাল, পান্থুমাই, মায়াবী ঝরনাসহ পর্যটনকেন্দ্রগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে।
গত ১৭ জুন উদযাপন হয় পবিত্র ঈদুল আযহা। ঈদ উপলক্ষে এ সময় সিলেটের পর্যটন কেন্দ্রগুলো পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত থাকার কথা। কিন্তু বন্যার কারণে বন্ধ ঘোষণা করায় সাদাপাথর, জাফলং, বিছনাকান্দি, রাতারগুলসহ সব পর্যটন কেন্দ্র জনমানবশূন্য হয়ে পড়ে। এতে আড়াই’শ কোটি টাকা লোকসানের মুখে পড়ে সিলেটের পর্যটন খাত।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত দেড় দশকে সিলেটের পর্যটন খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে এসেছেন প্রবাসী ও বেসরকারি উদ্যোক্তারা। গড়ে উঠেছে অসংখ্য হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট। গত এক দশকে সিলেটে পর্যটক সমাগমও বেড়েছে ব্যাপকহারে। ছুটির দিনগুলোতে সিলেটে কোনো হোটেল-মোটেলে কক্ষ খালি পাওয়া দুরূহ ব্যাপার। গত ঈদুল ফিতরেও সিলেটে হোটেল-মোটেল সিট খালি ছিলনা। আড়াই মাসের মাথায় সাম্প্রতিক বন্যায় বড় ধরণের হোচট খেয়েছে সিলেটের সম্ভাবনায় এই খাতটি। সামনে বড় ছুটি না থাকায় দীর্ঘ লোকসানের মূখে পড়ার শঙ্কায় এ খাত সংশ্লিষ্টরা।
ঈদের ছুটিতে সরেজমিনে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের সাদাপাথর পর্যটন কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, সাদাপাথর এলাকা পানির নিচে নিমজ্জিত, দেখা যাচ্ছে না পর্যটন স্পট। পাহাড়ি ঢলে ধলাই নদী ফুলে ফেঁপে উঠেছে। তাই সাদাপাথর এলাকায় যাওয়া পর্যটকদের জন্য দুরূহ ব্যাপার। তখন পর্যটকরা ঘাটে এসে নিরাশ হয়ে ফিরে যান নিজ গন্তব্যে। শুধু সাদাপাথর নয়, একই চিত্র ছিল জাফলং, রাতারগুলসহ সিলেটের সকল পর্যটন স্পটের। শুক্রবারও পর্যটকবাহী বেশকিছু গাড়ী সাদাপাথর ঘাটে গিয়ে ফিরে এসেছে।
স্থানীয়রা জানান, বছরে ২টা ঈদে পর্যটন খাতের মানুষগুলো বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে বসে থাকে। এর আগে করোনা এবং ২০২২ সালের প্রলয়ংকরী বন্যায় দীর্ঘসময় সিলেটে পর্যটন খাতে স্থবিরতা নেমে আসে। ঈদুল ফিতরে কিছুটা ব্যবসা হলেও ঈদুল আযহায় ব্যাপক লোকসানের মূখে পড়েন এই খাতের হাজার হাজার মানুষ। সামনে আর বড় ছুটি না থাকায় আরো দীর্ঘদিন অপেক্ষায় থাকতে হবে পর্যটক সংশ্লিষ্টদের।
সাদাপাথর পর্যটন ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক সফাত উল্লাহ বলেন, ঈদুল আযহা উপলক্ষে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ব্যাপক প্রস্ততি ছিল। অনেক ব্যবসায়ী ঋণ করে বিনিয়োগ করেছেন। দোকানে মালপত্র তুলেছেন। কিন্তু আকস্মিক বন্যায় ও পর্যটন কেন্দ্র বন্ধ হওয়ায় আমরা বিপুল ক্ষতির মুখে পড়েছি। ধার-কর্জ করে মালপত্র তুলে অনেকেই বিপাকে পড়েছেন। এই ক্ষতি সহজে কাটিয়ে উঠা সম্ভব নয়।
সিলেট হোটেল এন্ড গেস্ট হাউস ওনার্স এসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও গার্ডেন ইনের পরিচালক নওশাদ আল মুক্তাদির দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, আকস্মিক বন্যায় সিলেটের পর্যটন খাতে ধস নেমেছে। এই ক্ষতি আগামী ১ বছরেও কাটিয়ে উঠা সম্ভব নয়। কারণ বছরে ২টি ঈদকে আমরা প্রাধান্য দিয়ে থাকি। সারাবছরই হোটেল গেস্ট হাউসে মন্দাভাব বিরাজ করে। ঈদ ঘিরে সব হোটেল-মোটেলকে নতুনভাবে সাজানো হয়। কিন্তু এবার সবটুকুই লোকসান।
সিলেট হোটেল এন্ড গেস্ট হাউস ওনার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও ভ্যালী গার্ডেনের পরিচালক গোলাম কিবরিয়া দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, আমরা হোটেল ব্যবসায়ীরা ঈদুল আযহাকে কেন্দ্র করে বসে থাকি। কারণ ঈদুল আযহায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গ্রীষ্মকালিন ছুটি থাকে। ফলে সিলেটে বিপুল সংখ্যক পর্যটকের আগমন ঘটে। আর ঈদুল ফিতরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা এবং নানা পরীক্ষা থাকে। তাই সে সময় ব্যাবসাও তুলনামূলক কম হয়। কিন্তু এবারের ঈদুল আযহায় হোটেল মোটেল ব্যবসায়ীদের মাথা হাত। কারণ সামনে আর তেমন সরকারী ছুটি মিলবেনা। ফলে কাঙ্খিত পর্যটকও আসবেনা।
তিনি বলেন, আমাদের এসোসিয়েশনের অধীনে সিলেটের ৩০টির মতো হোটেল মোটেল রয়েছে। শুধু এই গুলোতে এই এ ঈদে কয়েক কোটি টাকার ব্যবসা হতো। বন্যার কারণে পর্যটন স্পট বন্ধ থাকায় পুরোটাই লোকসান হয়েছে।
এ ব্যাপারে সিলেট চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি ও হোটেল নির্ভানা ইনের সত্তাধিকারী তাহমিন আহমদ দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, ঈদের ছুটিগুলো হচ্ছে পর্যটন মৌসুম। কিন্তু ঈদে আকস্মিক বন্যায় সিলেটের পর্যটন কেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ফলে বন্ধ হয়ে যায় সব হোটেল-মোটেল। শুধু ঈদে সিলেটের পর্যটন খাতে লোকসান হয়েছে আড়াই’শ থেকে তিন’শ কোটি টাকা।
তিনি বলেন, শুধু হোটেল-মোটেল কিংবা রেষ্টুরেন্ট মালিকরাই নয়। ঈদে পরিবহন খাতের চালকরা ভালো ব্যবসা করে। বন্যার কারণে ঈদের সময় সিলেটের অধিকাংশ রুটে গাড়ী চলাচল বন্ধ ছিল। পর্যটকশুন্য সিলেটের কোন কেন্দ্রে যেতে পারেনি গাড়ী। ফলে পরিবহন সংশ্লিষ্টরা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।
সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, সিলেট হচ্ছে পর্যটনের জন্য সম্ভাবনাময় অঞ্চল। ঈদের ছুটিতে সিলেটে পর্যটকের ঢল নামে। এবার বন্যার কারণে এই খাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এর সঠিক সংখ্যাটা এখনই বলা যাচ্ছেনা। আমরা সিলেটের পর্যটন খাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরুপণের চেষ্টা করছি। পানি পুরোপুরি নেমে গেলে সংশ্লিষ্ট খাতের সকলের সাথে কথা বলে এই আকস্মিক বন্যার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরুপণ করবো।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে শর্তসাপেক্ষে সিলেটের পর্যটন কেন্দ্রগুলো খুলে দেয়া হয়েছে। প্রতিদিন পানি কমছে। পর্যটন স্পট খুলে দেয়া হলেও আমরা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি।