অসহনীয় বাজার, চাপে মধ্যবিত্ত
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ মার্চ ২০২৩, ৩:০০:৪০ অপরাহ্ন
এমজেএইচ জামিল :
সজীব আহমদ। কাজ করেন একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে। শুক্রবার ছুটির দিন তাই নিজের একমাত্র বাহন মোটরসাইকেল নিয়ে ছুটেছেন যাত্রী পরিবহনে। সন্ধ্যার পর দেখা হয় নগরীর লালদিঘীরপাড়স্থ হকার মার্কেটে। এসেছেন মাছ কিনতে। ঐ মার্কেটে তুলনামুলক কম দামে মাছ পাওয়া যায় তাই এখানে আসা। কয়েকটি দোকান ঘুরে ৪০০ টাকায় কিনেছেন ১ কেজি পাবদা মাছ।
তিনি জানান, ৫ বছর থেকে ১০ হাজার টাকা বেতনে একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করেছেন। এই সময়ে বেতন বেড়েছে মাত্র ১ হাজার টাকা। অথচ এই সময়ে তিনি বিয়ে করেছেন, হয়েছেন ১ সন্তানের বাবা। খরচ বেড়েছে কমপক্ষে ৩ গুণ। কিন্তু সেই হারে বাড়েনি বেতন। স্ত্রী ও কন্যা নিয়ে শহরে ৩ জনের পরিবার। গ্রামের বাড়ীতে থাকেন মা। মাসে গ্রামেও দিতে হয় খরচের টাকা। আয়ের ৩ গুণ ব্যয় মিটাতে রীতিমত হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। বাধ্য হয়ে ছুটির দিনেও মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়েছেন যাত্রী পরিবহনে। বেলা ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৭ টা পর্যন্ত ছুটেছেন নগরীর বিভিন্ন অলিগলিতে। ৭/৮ জন যাত্রী বহন করে আয় করেছেন ৭০০ টাকা। বাসার জন্য মাছ, তরকারি ও সন্তানের জন্য খাবার কিনতে ব্যয় হয়েছে সব।
শুক্রবার সন্ধ্যার পর নগরীর সিটি কর্পোরেশনের সামনে ব্রয়লারের ট্যাং (পা), মাথা ও কলিজা কিনতে এসেছেন গৃহবধু আলিয়া বেগম (ছদ্মনাম)। দরদাম করে ১০০ টাকা কেজিতে দেড়কেজি (পা), মাথা ও কলিজা কিনেছেন তিনি। জানালেন, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম স্বামী পেশায় শ্রমজীবি। ১ ছেলে, ২ মেয়ে ও স্বামী মিলে ৫ জনের সংসার। গেল ২ দিন থেকে কাজে যেতে পারেন নি স্বামী। ছোট মেয়ের আবদার মুরগির মাংস খাবে। কিন্তু একটা আস্ত মুরগী কেনার সামর্থ্য এই মুহূর্তে নেই। বোরকা পরে বেরিয়েছেন বাচ্চার আবদার পুরন করতে। তাতেই খুশী আলিয়া বেগম।
নগরীর বন্দরবাজারস্থ হেড পোষ্ট অফিসের সামনে কথা হয় রিক্সাচালক রহমত আলীর সাথে। রাস্তার পাশে রিক্সা থামিয়ে কিনছেন তরকারি। তুলনামুলক কম দামে তরকারি মিলে তাই এখান থেকেই কিনছেন তরকারি। জানালেন ৩ দিন আগেও টমেটো কিনেছেন ১০-১৫ টাকা কেজি। অথচ আজ বিক্রি হচ্ছে ২০-২৫ টাকা। নগরীর বিভিন্ন কাচাবাজারে টমেটোর কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকা। ১০টাকায় ১ আটি ধনেপাতা কিনতে পারলেও বাধ সেধেছে কাচামরিচ। ২৫০ গ্রাম কাচামরিচের দাম ৩৫ টাকা। শেষ পর্যন্ত দরদাম করে ৩০টাকায় কিনেছেন কাচামরিচ।
রহমত আলী জানান, কতদিন হয়ে গেছে গরুর মাংস খাইনি, সেটাও ভুলে গেছি। গেল মাসের শুরুর দিকে এক আত্মীয়ের বিয়েতে গিয়ে গরুর মাংস খাওয়ার সুযোগ হয়েছিল, তাও তিনি একা। ২ ছেলে, ১ মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে ৫ জনের সংসারে গরুর গোশত কেনা হয়না ২/৩ মাস ধরে। মাঝে মাঝে মুরগীর মাংস খাওয়া যেতো। সেটাও এখন ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। গরীবের ভরসার খাবার শুটকীর দামও বেড়েছে কেজিপ্রতি ১০০ টাকা। সবকিছুর দাম বেড়েছে। কিন্তু যাত্রীদের কাছে বেশী টাকা দাবী করলে করতে হয় ঝগড়া। কেই কেউ তো আবার গায়ে হাত পর্যন্ত তুলে। গরীবের দুঃখ আল্লাহ ছাড়া কেউ দেখার নাই।
উবার চালক সজীব, গৃহবধু আলেয়া ও রিক্সাচালক রহমত আলীর মতো সমাজের শ্রমজীবী ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো নিত্যপণ্যের উর্ধ্বগতির চাপে পিষ্ট হওয়ার উপক্রম।
শুক্রবার নগরীর বন্দরবাজার ঘুরে দেখা গেছে, স্থান ভেদে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২৩০-২৫০ টাকা। শুক্রবার সন্ধ্যায় নগরীর লালবাজারে ব্রয়লার মুরগি ২২৫-৩০ টাকা কেজিতে বিক্রি হতে দেখা গেছে। ২ কেজি ওজনের লাল মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকা। তবে এলাকার বাজার এবং পাড়া মহল্লায় ব্রয়লার মুরগি ২৪০-২৫০ টাকা ও লাল মুরগি ৩৩০-৩৫০টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।
বন্দরবাজারের বিভিন্ন দোকানে গরুর মাংস ৭০০-৭২০ টাকা কেজিতে বিক্রি হলেও নগরীর বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক বাজারে গরুর মাংস ৭৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।
শুক্রবার সন্ধ্যায় নগরীর বন্দরবাজারস্থ লালবাজার ঘুরে দেখা গেছে, আকারভেদে প্রতি কেজি রুই মাছ ৩৫০-৫০০ টাকায়, বোয়াল মাছ ৪০০-৪৫০ টাকা, শিং মাছ ৩৫০-৪০০ টাকা, টেংরা মাছ ৬০০-৭০০ টাকা, রূপচাঁদা মাছ ৫০০-৬০০ টাকা, পাবদা মাছ ৫০০-৬০০ টাকা, কৈ মাছ ৩০০-৪০০ টাকা, চিংড়ি মাছ ৫০০-৫৫০ টাকায়, ফাঙাশ ও তেলাপিয়া মাছ ১৭০-১৮০ টাকা ধরে বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে মুদি বাজারে সপ্তাহের ব্যবধানে নতুন করে বেড়েছে ডাল ও ছোলার দাম। চিনির সংকট এখনও কাটেনি। শুক্রবার সিলেটের বাজারে প্রতি কেজি ছোলা বিক্রি হয়েছে ১০০-১০৫ টাকা দরে, যা গত সপ্তাহে ৯০-৯৫ টাকা ছিলো। একইভাবে ১০ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি বুটের ডাল ৯৫-১০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারে এখন পেঁয়াজের দাম কম থাকলেও কমেনি আদা-রসুনের দাম। প্রতি কেজি আদা বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ১৪০-২০০ টাকা ও রসুন ১৬০-২০০ টাকা দরে। এছাড়া তেল, চিনি, আটা, ময়দা, গুঁড়া দুধসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আগের বাড়তি দামে আটকে রয়েছে। বাজারে শুধু তুলনামুলক কম দামে বিক্রি হচ্ছে পেঁয়াজ ও আলু। শুক্রবার নগরীতে ২৫-৪০ টাকা কেজি পেঁয়াজ ও ২০-২৫ টাকা কেজি ধরে আলু হতে দেখা গেছে।
শুক্রবার নগরীর বিভিন্ন কাঁচাবাজারে- বাঁধাকপি ও ফুলকপি ৩০ টাকা কেজি, কুমড়া সাইজভেদে প্রতি পিস ৫০-৬০ টাকা, লম্বা ও গোল বেগুন কেজি ৪০-৫০ টাকা, টমেটো ২৫-৩০ টাকা, শিম ৪০-৫০ টাকা, ঢ্যাঁড়স ৬০-৭০ টাকা, করলা ৮০-১০০ টাকা, বরবটি ৬০-৭০ টাকা কেজি, চিচিঙ্গা ৭০ টাকা, ঝিঙ্গা ৭০ টাকা, পেঁপে ৩০ টাকা, ধনিয়া পাতা ১০০ টাকা, গাজর ৪০-৫০ টাকা, মুলা ৩০-৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া লেবু সাইজভেদে হালি ৩০-৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
নগরীর বন্দরবাজারের এক মুদি দোকানী জানান, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে শুধু ক্রেতা নয় আমরা বিক্রেতারাও বিব্রত। অনেক পরিচিত ক্রেতা যেখানে ১ কেজি ডাল কিনতেন সেখানে তিনি মাত্র ২৫০ গ্রাম ডাল কিনতে আসছেন। কিন্তু আমরা কি করবো। আমাদের লাভ অনেক কমেছে। ৫০০ টাকা দামের পণ্য বিক্রি করে আগে যেখানে ৫০-৬০ টাকা লাভ হতো। সেখানে ১০-২০ টাকা লাভ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। আমাদেরও দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ বিলসহ সকল খরচ বেড়েছে। আমরা কার কাছে বলবো।