গ্রামে ভয়াবহ লোডশেডিং : সরবরাহ ভাল নগরে
প্রকাশিত হয়েছে : ০২ জুন ২০২৩, ৬:১৭:০৯ অপরাহ্ন
এমজেএইচ জামিল : টানা ৩/৪ দিন ধরে বয়ে চলা তাপপ্রবাহের কারণে গরমে জনজীবন অতিষ্ঠ। এতে বেড়েছে বিদ্যুতের চাহিদা। কিন্তু জ্বালানির অভাবে একের পর কেন্দ্র বন্ধ হওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে লোডশেডিং। সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে নগর এলাকায় বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও শহরতলী থেকে শুরু করে জেলা-উপজেলা ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে গড়ে ৮-১০ ঘন্টা বিদ্যুৎ পাচ্ছেনা মানুষ। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন বিভাগের কয়েক ৫ লক্ষাধিক বিদ্যুৎ গ্রাহক।
এদিকে সিলেটে প্রতিনিয়ত তাপমাত্রা বাড়তে থাকায় গরমজনিত রোগব্যাধি বাড়ছে। এরই মধ্যে তীব্র গরমে বুধবার নগরীতে হিটস্ট্রোকে একজনের মৃত্যু হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গেল মে মাসের শেষ দিকে এসে ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের কবলে পড়েছে সিলেট। তেল ও গ্যাস সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে সংশি¬ষ্টরা বলছেন। কয়লা ও গ্যাসের অভাবে একের পর এক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বন্ধ হওয়ায় কমছে বিদ্যুৎ উৎপাদন। ফলে প্রতিদিন চাহিদার চেয়ে অনেক কম বিদ্যুৎ কম উৎপাদন হচ্ছে। এ ঘাটতি পূরণে সারাদেশে লোড ভাগ করে দেওয়া হচ্ছে। ফলে নগরীতে কম লোডশেডিং হলেও বিভাগজুড়ে প্রতিদিন গড়ে ১২ ঘণ্টাই থাকছে না বিদ্যুৎ।
গ্রাহকরা জানিয়েছেন- প্রায় প্রতি ঘন্টায় লোডশেডিং হচ্ছে সিলেটের দক্ষিণ সুরমাসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলায়। একই চিত্র মৌলভীবাজার জেলার বিভিন্ন উপজেলায়। জেলা সদরে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি মোটামুটি স্বাভাবিক থাকলেও শহরের বাইরে উপজেলা ও গ্রাম পর্যায়ে লোডশেডিং বেড়েছে কয়েকগুণ। এমন দৃশ্য হবিগঞ্জ জেলার বিভিন্ন উপজেলা এবং সুনামগঞ্জ জেলার বিভিন্ন উপজেলা ও প্রত্যন্ত এলাকায়।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সিলেট বিভাগীয় অফিস সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার দিনে বিভাগে ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদার বিপরীতে বরাদ্দ পাওয়া গেছে ৫৩০ মেগাওয়াট। বিশেষ করে নগর এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবিচ্ছিন্ন রাখায় শহরের বাইরে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিভাগজুড়ে ব্যাপক বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন পল্লী বিদ্যুৎ গ্রাহকগণ। তারা দিনে রাতে গড়ে অর্ধেক সময় বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছেন। এই অভিযোগ স্বীকার করেছেন খোদ পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ। চাহিদার ৬৫ থেকে ৭০ ভাগ বিদ্যুৎ বরাদ্দ পাওয়ায় পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহকদের ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ লোডশেডিং করতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন না বাড়লে এই পরিস্থিতি থেকে সহসা উত্তরণের কোন পথ দেখছেন না বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন, ৮ বা ৯ জুন বিচ্ছিন্নভাবে বৃষ্টি হতে পারে। অর্থাৎ ৭ জুন পর্যন্ত দেশের তাপমাত্রা বেশি থাকার আশঙ্কা রয়েছে। এর মধ্যে ৩ জুন পুরোপুরি উৎপাদন বন্ধ করে দিতে পারে দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র পটুয়াখালীর পায়রা। এতে লোডশেডিং আরও বাড়তে পারে। কয়লার অভাবে এখন উৎপাদন হচ্ছে সক্ষমতার অর্ধেকের চেয়ে কম। ৬০০ মেগাওয়াট করে উৎপাদন করছে কেন্দ্রটি।
বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গরম না কমায় বিদ্যুৎ পরিস্থিতিরও আরও অবনতি হয়েছে। চাহিদা যত বাড়ছে, ঘাটতিও তত বাড়ছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) বলছে, বুধবার দিবাগত মধ্যরাতে লোডশেডিং আড়াই হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে। রাতভর প্রতি ঘণ্টায় দুই হাজার মেগাওয়াটের বেশি করে লোডশেডিং হয়েছে।
তবে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী দেশের ৬টি বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থার তথ্য বলছে, বুধবার দিবাগত রাতে লোডশেডিং হয়েছে তিন হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি। দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) বুধবার দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দেড় হাজার মেগাওয়াট করে লোডশেডিং করেছে প্রতি ঘণ্টায়। সন্ধ্যার পর এটি আরও কিছুটা বেড়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় তারা সরবরাহ কম পেয়েছে ১ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট।
বুধবার বিকেল চারটায় ডিপিডিসির বিদ্যুৎ চাহিদা ছিল ১ হাজার ৯০৫ মেগাওয়াট। চাহিদার চেয়ে ৩২৪ মেগাওয়াট কম সরবরাহ পেয়েছে তারা। আর একই সময়ে ডেসকোর চাহিদা ছিল ১ হাজার ২৭৯ মেগাওয়াট। তারা সরবরাহ কম পেয়েছে ১৭৯ মেগাওয়াট। মঙ্গলবারের চেয়ে বুধবার লোডশেডিং বেড়েছে চাহিদা বাড়ায়। বৃহস্পতিবার এটি আরও বেড়েছে।
সিলেটের দক্ষিণ সুরমাসহ বিভিন্ন উপজেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লোডশেডিংয়ে বিপর্যস্ত জনজীবন। সিলেটের অনেক উপজেলায় প্রতিদিন কমপক্ষে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর লোডশেডিং বেশি হচ্ছে। শহর থেকে গ্রাম, সবখানে ভয়াবহ লোডশেডিং। গ্রামে রাত-দিন সমানতালে চলে লোডশেডিং।
এদিকে নগরীর বিভিন্ন এলাকাগুলো পিডিবি’র অধীনে থাকায় সিটি নির্বাচনের জন্য অনেকটা লোডশেডিং মুক্ত রয়েছে। একই সাথে পল্লী বিদ্যুতের আওতায় থাকা দক্ষিণ সুরমার ৪টি ওয়ার্ড সিটি নির্বাচন উপলক্ষে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাচ্ছে। যদিও সেসব এলাকায় রাতের বেলা লোডশেডিং হচ্ছে। তবে সেটা তুলনামুলক কম।
এদিকে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের অধীনে থাকা গ্রামীণ জনপদের মানুষকে কঠিন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। গ্রামে ২৪ ঘণ্টার বেশিরভাগ সময় বিদ্যুৎহীন থাকে বলে অভিযোগ করেন বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দারা। রোববার থেকে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেলে লোডশেডিংয়ের মাত্রা আরো বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, তাপপ্রবাহের কারণে দেশে গরম বেড়েছে। বেড়েছে বিদ্যুতের চাহিদাও। কিন্তু পর্যাপ্ত উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি নেই। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের একাংশ অলস বসে থাকছে, বাড়ছে লোডশেডিং। বিদ্যুতের ঘাটতি বাড়লে সাধারণত গ্রামে বেশি লোডশেডিং করা হয়। তবে এখন রাজধানীতে লোডশেডিং করা হচ্ছে। যদিও সিলেটে এখন তেমন লোডশেডিং হচ্ছেনা। তবে উপজেলা পর্যায়ে লোডশেডিং চরমে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে এখন বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ১৫৩। গত সোমবারের (২৯ মে) হিসাবে, ওই দিন অন্তত ৫২টি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ ছিল। কোনো কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ ছিল কয়লা, গ্যাস অথবা জ্বালানি তেলের অভাবে। রক্ষণাবেক্ষণসহ বেশ কিছু কারণে বন্ধ ছিল কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র। এটা প্রায়ই হয়ে থাকে বলে জানান, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) একাধিক কর্মকর্তা। তাঁরা বলেন, উৎপাদন বন্ধ থাকলেও বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ক্যাপাসিটি চার্জ বা কেন্দ্রভাড়া পরিশোধ করতে হয়। পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে কেন্দ্রভাড়া দিতে হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
দক্ষিণ সুরমা উপজেলার জালালপুর এলাকার বাসিন্দা খালেদ আহমদ জানান, পল্লী বিদ্যুতের ফেঞ্চুগঞ্জ ফিডারের সাথে থাকা দক্ষিণ সুরমা উপজেলা, জালালপুর, গোয়ালাবাজার, দাউদপুর ও লালাবাজার এলাকার বাসিন্দারা ব্যাপক দুর্ভোগে আছেন। এসব এলাকায় দিনে রাতে গড়ে ৬-৮ ঘন্টা বিদ্যুৎ থাকে কিনা সন্দেহ আছে। তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেন।
এ ব্যাপারে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি সিলেট-১ এর জেনারেল ম্যানেজার মো: আখতারুজ্জামান লস্কর দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, আমরা চাহিদার ৬৫-৭০ শতাংশ বিদ্যুৎ বরাদ্দ পাচ্ছি। এরমধ্যে নগর এলাকায় ৪টি ওয়ার্ড আমাদের আওতায় থাকায় সেখানে বেশী সময় বিদ্যুৎ সরবরাহ রাখতে হয়। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন থেকে আমাদের উপর নির্দেশনা আছে। একদিকে বেশী দিলে অন্যদিকে সরবরাহ কিছুটা কম হতে পারে। তবে আমরা আমাদের গ্রাহকদেরকে সর্বনিম্ন ১২ঘন্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ করে থাকি। গড়ে ৮-১০ ঘন্টার বেশী লোডশেডিং আমরা করিনা।
হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার কসবা এলাকার বাসিন্দা হাফিজ মাওলানা ঈসমাইল খান অভিযোগ করেন, কসবা এলাকাটি পল্লী বিদ্যুতের আওতাধিন। কিন্তু সেখানে দিনে রাতে গড়ে ৬-৮ ঘন্টা বিদ্যুৎ থাকে। বুধবার দিবাগত রাতে ৯বার লোডশেডিং হয়েছে। এই তীব্র গরমে এত বেশী লোডশেডিংয়ে সুস্থ মানুষরা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। অসুস্থ, বৃদ্ধ ও শিশুরা চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন।
পিডিবি সুনামগঞ্জ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মশিউর রহমান জানান, বরাদ্দ কম থাকায় সরবরাহ কিছুটা কমেছে। বৃহস্পতিবার আমার এলাকায় ৮ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে বরাদ্দ পেয়েছে ৬ মেগাওয়াট। ফলে ২ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হয়েছে।
এ ব্যাপারে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বিতরণ বোর্ড সিলেট বিভাগীয় অফিসের সহকারী প্রকৌশলী মো. জারজিসুর রহমান রনি দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকলেও সিলেট নগরীতে লোডশেডিং হচ্ছেনা। শহরের বাইরে কিছু এলাকায় নির্দিষ্ট সময় লোডশেডিং করতে হচ্ছে। উৎপাদন স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত লোডশেডিং কমার সম্ভাবনা নেই। বৃহস্পতিবার দুপুরে সিলেট বিভাগে ৬০০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে বরাদ্দ পাওয়া গেছে ৫৭০ মেগাওয়াট।