সিলেট অঞ্চলে ৩৭ ও নগরে ৭০ শতাংশ সরকারী প্রাইমারী স্কুলে নেই খেলার মাঠ
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ জুলাই ২০২৩, ৬:০০:২৫ অপরাহ্ন
৩ হাজার ২০৩ টির মাঝে ১ হাজার ৮৪৭টি মাঠশূন্য
এমজেএইচ জামিল :
শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে খেলাধুলা। আর খেলাধুলার জন্য দরকার পর্যাপ্ত খেলার মাঠ। অথচ দিন দিন খেলার মাঠসহ সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে বিনোদনের সব জায়গা। যেখানে প্রত্যেক বিদ্যালয়ে মাঠ থাকার কথা সেখানে নেই পর্যাপ্ত খেলার মাঠ। এমনকি সিলেট বিভাগের ৩৭ শতাংশ সরকারী প্রাইমারী স্কুলে নেই খেলার মাঠ। আর সিলেট নগরের ৭০ ভাগ স্কুলে নেই খেলার মাঠ।
এছাড়া বিভাগের বিভিন্ন স্থানে ব্যাঙ্গের ছাতার মতো গজিয়ে উঠা কিন্টারগার্ডেন স্কুলে কোন রকম বাসা ভাড়া করেই চলছে শ্রেণী কার্যক্রম। ফলে শারীরিক বিকাশের মাধ্যম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা।
জানা গেছে, সিলেট বিভাগে সাড়ে ৫ হাজার ৫৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এরমধ্যে ৩ হাজার ২০৩ টি স্কুলে খেলার মাঠ থাকলেও ১ হাজার ৮৪৭ টি বিদ্যালয়ে নেই কোনো খেলার মাঠ। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাঠ ও স্থান স্বল্পতার জন্য শিশুরা বঞ্চিত হচ্ছে বিদ্যালয়ে খেলাধুলার অধিকার থেকে। খেলাধুলা ও চিত্তবিনোদন থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে শিশু-কিশোররা ঘরে বসে ইলেকট্রনিক যন্ত্রনির্ভর হয়ে টিভিতে কার্টুন আর কম্পিউটার ও স্মার্টফোনে গেমসের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন সচেতন অভিভাবকসহ এলাকাবাসী। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ করে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় খেলার মাঠ তৈরির দাবি জানান তারা।
জানা গেছে, দেশের প্রাথমিক শিক্ষার নানা দিক নিয়ে প্রতি বছর ‘অ্যানুয়াল প্রাইমারি স্কুল সেন্সাস’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। সেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সংখ্যা, শ্রেণীকক্ষ, স্যানিটেশন, খেলার মাঠসহ বিভিন্ন সেবা ও সুযোগ-সুবিধার তথ্যাদি তুলে ধরা হয়। ২০২১ শিক্ষাবর্ষের তথ্যের ভিত্তিতে প্রণীত অধিদপ্তরের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৬৫ হাজার ৫৬৬টি। এর মধ্যে খেলার মাঠ রয়েছে ৫৪ হাজার ৮২৬টিতে। সে হিসাবে দেশের ১০ হাজার ৭৪০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেট অঞ্চলের মোট ৩৭ শতাংশ অর্থাৎ ১ হাজার ৮৪৭ টি প্রাইমারী স্কুলে খেলার মাঠ নেই। এরমধ্যে সিলেট জেলার ১ হাজার ৪৭৩ টি সরকারী প্রাইমারী স্কুলের মধ্যে ১ হাজার ২৫ টি স্কুলে খেলার মাঠ থাকলেও ৪৪৮টি স্কুলে কোন খেলার মাঠ নেই। সুনামগঞ্জ জেলার ১ হাজার ৪৬৭টি সরকারী প্রাইমারী স্কুলের মধ্যে ৭৮১ টি স্কুলে খেলার মাঠ থাকলেও ৬৮৬টি স্কুলে কোন খেলার মাঠ নেই। মৌলভীবাজার জেলার ১ হাজার ৪৪টি সরকারী প্রাইমারী স্কুলের মধ্যে ৭২৪ টিতে খেলার মাঠ থাকলেও ৩২০ টি স্কুলে খেলার মাঠ নেই। হবিগঞ্জ জেলার ১ হাজার ৬৬টি সরকারী প্রাইমারী স্কুলের মধ্যে ৬৭৩টি স্কুলে খেলার মাঠ থাকলেও ৩৯৩টি স্কুলে খেলার মাঠ নেই। এছাড়া সারাদেশে খেলার মাঠ না থাকা সরকারি প্রাইমারী স্কুলের সংখ্যা সাড়ে ১০ হাজারের বেশি।
শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, খেলার মাঠ ব্যতিত একটি বিদ্যালয় কোনোভাবেই পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হতে পারে না। তাই খেলার মাঠ ছাড়া কোনো বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা সমীচীন নয়। আর যেসব অনুমোদিত বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ নেই, সেসব প্রতিষ্ঠানে বিশেষ প্রকল্পের আওতায় খেলার মাঠ স্থাপন করা প্রয়োজন।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশের মধ্যে খেলার মাঠের দিক থেকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে সিলেট অঞ্চলের প্রাইমারী স্কুলগুলো। সিলেট বিভাগের মোট ৫ হাজার ৫০টি প্রাইমারী স্কুলের মধ্যে খেলার মাঠ আছে ৩ হাজার ২০৩টির। এ অঞ্চলে খেলার মাঠ না থাকা সরকারী প্রাইমারী স্কুলের সংখ্যা হচ্ছে ১ হাজার ৮৪৭টি। সে হিসাবে সিলেট অঞ্চলের প্রায় ৩৭ শতাংশ প্রাইমারী স্কুলের খেলার মাঠ নেই। ফলে এসব স্কুলে পড়াশোনা করলেও খেলাধুলায় পিছিয়ে রয়েছে শিক্ষার্থীরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সিলেট জেলার ১২টি উপজেলার একাধিক পৌর এলাকা ও উপজেলা সদরের বিদ্যালয়গুলোতে এ সমস্যা বেশি। সিলেট নগরীর অর্ধেকেরও বেশি প্রাইমারী স্কুলে খেলার মাঠ নেই। সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তারা এ তথ্য জানিয়েছেন। সিলেট জেলায় মোট ১ হাজার ৪৭৭ টি সরকারি প্রাইমারী স্কুল রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিদ্যালয় আছে বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জে। সিলেট নগরীসহ সদর উপজেলায় রয়েছে ১২৫টি সরকারি প্রাইমারী স্কুল। যার মধ্যে সিলেট নগরীতে পড়েছে ৫৩টি।
সিলেট সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, সিলেট নগরীর ৭০ ভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ নেই। এর মধ্যে দরগাহ জালালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মধুশহীদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বখতিয়ার বিবি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দর্শনদেউড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কিশোরী মোহন বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাঠানটুলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বেশির ভাগ স্কুলেই খেলার মাঠ নেই। সংশ্লিষ্টরা জানান, বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী থাকায় অনেক সময় দৈনিক সমাবেশ করাতেও শিক্ষকদের কষ্ট হয়।
এমন চিত্র শুধু সিলেট নগরী কিংবা সিলেট জেলার গুটিকয়েক উপজেলার নয়। এমন দৃশ্য বিভাগের সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলায়ও বিদ্যমান রয়েছে। বিশেষ করে সিলেট বিভাগের মহানগর, জেলা ও উপজেলা সদর এবং পৌর এলাকার প্রাইমারী স্কুলগুলোতে খেলার মাঠ না থাকার পরিমাণ বেশী। তবে গ্রামীণ জনপদে স্কুলের বিল্ডিংয়ের সাথেই খেলার মাঠ থাকে, আর স্কুলের সাথে না থাকলেও অধিকাংশ গ্রামের পঞ্চায়েতী মাঠেও প্রাইমারী শিক্ষার্থীরা খেলাধূলাসহ নানা প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে পারে।
এ ব্যাপারে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তির সাথে আলাপাকালে তারা বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শ্রেণীকক্ষের তুলনায় শ্রেণীকক্ষের বাইরের শিক্ষা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। খেলাধুলার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব তৈরি হয়। খেলতে গিয়ে একে অপরের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে, সামাজিকীকরণ হয়। তাই বিদ্যালয় যখন প্রতিষ্ঠা করা হয়, তখন অবশ্যই মাঠের বিষয়টি খেয়াল রাখা উচিত। বর্তমানে যেসব বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ নেই, সরকারের উচিত সেখানে নতুন মাঠের ব্যবস্থা করা। কারণ খেলার মাঠ ছাড়া একটি বিদ্যালয় পূর্ণাঙ্গ হয় না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকটি উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তারা জানান, নগর ও পৌর শহর এলাকায় সাধারণত দানকৃত জমিতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো গড়ে তোলা হয়েছিল। শহরাঞ্চলে জমির দাম বেশি হওয়ায় দানকৃত জমির পরিমাণ অনেক কম। তাই অনেক ক্ষেত্রে সেখানে শুধু একাডেমিক ভবন তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। নদী বা পুকুরের কারণে যদি বিদ্যালয়ের কাঠামো ক্ষতির সম্মুখীন হয়, সেক্ষেত্রে জমি অধিগ্রহণের নিয়ম আছে। তবে খেলার মাঠের জন্য জমি অধিগ্রহণের কোনো সুযোগ এখন নেই।
এ বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ পরিচালক জালাল উদ্দিন দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, প্রতিবছর ‘অ্যানুয়াল প্রাইমারি স্কুল সেন্সাস’ প্রতিবেদনের জন্য আমরা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস থেকে তথ্য অধিদপ্তরে প্রেরণ করি। আমি সিলেটে যোগদানের পূর্বেই এ সংক্রান্ত তথ্য প্রেরণ করা হয়েছে। তবে চলতি বছর নতুন করে অধিদপ্তর মাঠের রিপোর্ট না চাওয়ায় এই খেলার মাঠ বেড়েছে কিনা সেই তথ্যটি আমাদের হাতে নেই। তবে মাঠ বাড়ার কোন সম্ভবনা নেই। কারণ যেসব স্কুল অনেক আগে মাঠ ছাড়াই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে তাদের নতুন করে মাঠ বানানোর সুযোগ নেই। কারণ দিন দিন মানুষ বাড়ছে। পুকুর মাঠ ঘাট ভরাট হয়ে নতুন নতুন বাসা বাড়ী তৈরী হচ্ছে। ফলে নতুন করে স্কুলের জন্য খেলার মাঠ পাওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
এদিকে আনন্দঘন শিক্ষা পরিবেশ নিশ্চিত করতে নির্বাচিত ১০ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ উন্নয়ন প্রকল্প (জুলাই ২০২৩-জুন ২০২৬) গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। গত ১ জুন জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে প্রস্তাবিত বাজেট পেশকালে অর্থমন্ত্রী এই ঘোষণা দেন।
বাজেটে অর্থমন্ত্রী বলেন, শিক্ষাকে কোমলমতি শিশুদের জন্য আনন্দঘন করার উদ্দেশে আমরা সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিকক্ষ সজ্জিতকরণ কার্যক্রম পরিচালনা করছি। নির্বাচিত ১০ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ উন্নয়ন প্রকল্প (জুলাই ২০২৩-জুন ২০২৬) গ্রহণ করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ পরিচালক জালাল উদ্দিন বলেন, সরকার চাইলে খেলার মাঠ তৈরী করা কোন বিষয় নয়। প্রয়োজনীয় বাজেট পেলে যেসব স্কুলে খেলার মাঠ নেই সেসব স্কুলে খেলার মাঠ তৈরী করা সম্ভব।
তিনি বলেন, স্কুলের সাথে খেলা মাঠ শুধু দরকার বললে হবেনা, অবশ্য থাকা উচিত বলতে হবে। আর প্রাইমারী শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য পড়াশোনার চাইতে খেলাধূলার গুরুত্ব কোনভাবে কম নয়। একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করার সময় খেলার মাঠ সংযুক্ত করেই তৈরী করা উচিত। আর স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে পরবর্তীতে খেলার মাঠ সংযুক্ত করার জন্য আলাদা কোন বরাদ্দ নেই। তবে যদি সংশ্লিষ্ট এলাকার কোন দানশীল স্কুলের মাঠের জন্য ভুমি দান করেন তাহলে যেসব স্কুলের মাঠ নেই সেসব স্কুলের শিক্ষার্থীরা মাঠ পেতে পারেন। এর বাইরে সরকারীভাবে মাঠ কেনার জন্য আলাদা বরাদ্দ নেই। সরকারি বিদ্যালয়ের অধিকাংশেই খেলার মাঠ রয়েছে। হয়তো কিছু প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার সময় খেলার মাঠ নিয়ে কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়নি। তবে বর্তমানে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে খেলার মাঠের বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। সরকারী বরাদ্দ পেলে যেসব স্কুলে খেলার মাঠ নেই সে ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া হবে।