সব ওয়ার্ডেই এডিসের লার্ভা !
প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ আগস্ট ২০২৩, ৬:০০:১৪ অপরাহ্ন
নগরজুড়ে বাড়ছে ডেঙ্গুঝুঁকি
এমজেএইচ জামিল :
সারাদেশের ন্যায় সিলেটেও হু হু করে বাড়ছে ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা। নগর থেকে গ্রাম, বিভাগের প্রায় সব উপজেলা থেকেই শনাক্ত হচ্ছেন ডেঙ্গুরোগী। এমন পরিস্থিতিতে চরম ডেঙ্গুঝুঁকিতে রয়েছে সিলেট মহানগরী। ইতোমধ্যে নগরীর সব ওয়ার্ডে এডিসের লার্ভা পাওয়ায় ডেঙ্গুর কমিউনিটি সংক্রমণের শঙ্কা ক্রমশ বাড়ছে। যদিও ডেঙ্গু প্রতিরোধে নগরজুড়ে এডিসের লার্ভার অনুসন্ধান ও ধ্বংস করা কার্যক্রম জোরদার করেছে সিলেট সিটি কর্পোরেশন। লার্ভা পাওয়া যাওয়া স্থান ও ভবনের মালিককে করা হচ্ছে জরিমানা।
নগরের পুরাতন ২৭টি ওয়ার্ডে অভিযান জোরদার হলেও এখনো অভিযানের ছোয়া পাচ্ছেনা বর্ধিত নতুন ১৫টি ওয়ার্ড। ফলে সেসব এলাকার বাসিন্দাগণ রয়েছেন উচ্চ ডেঙ্গুঝুঁকিতে। এদিকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি বিবেচনায় আগামীকাল সোমবার দুপুরে সিটি কর্পোরেশন পরিষদের সাধারণ সভা ডাকা হয়েছে। একেক দিন একেক ওয়ার্ডে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালালেও তাতে কার্যকর ফলাফল নিশ্চিত হচ্ছে না। এ অবস্থায় একযোগে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিতেই মূলত এই সভা ডাকা হয়েছে বলেছে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিসিকের পুরনো ২৭টি ওয়ার্ডে অভিযানে এডিসের লার্ভা পাওয়া গেলেও নতুন ১৫টি ওয়ার্ডে এখনো শুরু হয়নি অভিযান। জনবল সঙ্কটের কারণে বর্ধিত ওয়ার্ডে অভিযান চালানো যাচ্ছেনা বলে জানিয়েছে সিসিক। এদিকে বর্ধিত ২টি ওয়ার্ডের কিছু স্থানে (পুরাতন ওয়ার্ডের পাশর্^বর্তী) পরীক্ষামূলক অভিযানে মিলেছে এডিসের লার্ভা। ফলে নতুন প্রায় সব ওয়ার্ডে এডিসের লার্ভা থাকার বিষয়টি উড়িয়ে দিচ্ছেন না সিসিকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ। তবে এখনই বর্ধিত ওয়ার্ডসমূহে অভিযান করা যাচ্ছেনা বলে সিসিক সূত্রে জানা গেছে।
জানা গেছে, নগরীর প্রায় ৪২টি ওয়ার্ডেই কমবেশি এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেলেও ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধির এই সময়ে এডিস মশা নিধনে সিসিক কার্যকর অভিযান পরিচালনা করতে পারছেনা বলে অভিযোগ করেছেন অনেকে। যদিও সিসিক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রতিদিনই অভিযান চলছে। শনিবার (গতকাল) থেকে অভিযান জোরদার করতে ওয়ার্ডভিত্তিক ১০জন পরিছন্নতা কর্মী কাজ শুরু করেছে বলে সিসিক সূত্রে জানা গেছে।
নগরীর কয়েকটি এলাকার অধিবাসীদের অভিযোগ, নগরীর নালা-নর্দমা নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না করায় মশার উপদ্রব বেড়েছে। সন্ধ্যার পর মশার যন্ত্রণায় ঘরে বাইরে কোথায় থাকা যাচ্ছেনা। এমনকি দিনের বেলাও মশার কামড়ে অতিষ্ঠ জনসাধারণ। বাসাবাড়ি, নালা-নর্দমা ও বিভিন্ন স্থাপনায় পানি জমে থাকলেও তা অপসারণে সিসিকের কার্যকর উদ্যোগে চোখে পড়ছেনা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গেল ২৪ ঘন্টায় নতুর করে আরো ২৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ডেঙ্গু শনাক্ত হন তারা। এরমধ্যে সিলেট জেলায় ২, সুনামগঞ্জে ১, হবিগঞ্জে ১৭ ও সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধিন ৫ জন রয়েছেন।
এ নিয়ে সিলেট বিভাগে চলতি মওসুমে ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৩৮ জনে। এরমধ্যে সিলেট জেলায় ১২৪, সুনামগঞ্জে ২৯, হবিগঞ্জে ২০১, মৌলভীবাজারে ৩৩ ও সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধিন ১৫১ জন রয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে সিলেট বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতাল, ক্লিনিক, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৩২ জন ডেঙ্গুরোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। চলতি মওসুমে ৫৩৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হলেও ইতোমধ্যে সুস্থ হয়েছেন ৪০৬ জন। দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের মৃত্যুর রেকর্ড ছাড়িয়ে গেলেও চলতি মওসুমে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে সিলেটে কেউ মারা যায়নি। তবে গত জুলাই মাসে সিলেট বিভাগে রেকর্ডসংখ্যক ৩৮২ জন ডেঙ্গুরোগী শনাক্ত হয়েছেন। জুলাইয়ে দৈনিক গড়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ১৩ জন।
এছাড়া চলতি আগস্ট মাসের ৫ দিনে সিলেটে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ৯২ জন। প্রতিদিন গড়ে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ১৯ জন।
এদিকে চলতি মওসুমের জানুয়ারী থেকে জুন পর্যন্ত বিভাগে শনাক্ত হওয়া ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা ৬৩ জন। এরমধ্যে জানুয়ারীতে ৩ জন, এপ্রিলে ১ জন, মে মাসে ১ জন ও জুন মাসে শনাক্ত হয়েছেন ৫৯ জন।
সিসিকের স্বাস্থ্যবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সিলেট বিভাগে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়লেও নগরীতে স্থানীয়ভাবে আক্রান্তের তেমন রিপোর্ট নেই। ইতোমধ্যে নগরীতে ডেঙ্গু আক্রান্ত প্রায় সবারই ট্রাভেল হিস্ট্রি রয়েছে। এরপরও নগরীতে এডিসের লার্ভা পাওয়ায় নগরবাসী ডেঙ্গুঝুঁকিতে রয়েছেন। সিসিকের স্বাস্থ্যবিভাগ ও পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা বিভাগ নগরজুড়ে এডিসের লার্ভা অনুসন্ধানে ও ধ্বংসে তৎপর রয়েছে। এছাড়া ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পেতে নিজের বাসা ও আশপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে নগরে ব্যাপকভাবে সচেতনতা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। লিফলেট বিতরণের পাশাপাশি মাইকিং করেও চলছে সচেতনতামূলক প্রচারণা।
তবে সিসিকের এমন তৎপরতায় সন্তুষ্ট নয় অনেকেই। নগরীর শামীমাবাদ এলাকার বাসিন্দা মাওলানা আব্দুর রশীদ বলেন, শামীমাবাদ এলাকার মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছড়া-খালে দীর্ঘদিন ধরে ময়লা-আবর্জনা জমে আছে। দুর্গন্ধের পাশাপাশি বাসা বেধেছে মশা। এব্যাপারে নগর কতৃপক্ষের কোন উদ্যোগ চোখে পড়ছেনা। ফলে মশার যন্ত্রনায় আমাদের দিন কাটছে।
এদিকে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, নগরীর শামীমাবাদ, কানিশাইল, নবাব রোড, ঘাসিটুলা, বেতেরবাজার, আখালিয়া, কুমারগাও, কালীবাড়ি, পনিটুলা, উপশহর, কালীঘাটসহ বিভিন্ন এলাকায় রাস্তার পাশে ময়লা-আবর্জনা স্তূপাকারে পড়ে আছে। এ ছাড়া নগরীর অর্ধশতাধিকেরও বেশী স্থানে নালা-নর্দমা উন্মুক্ত। এছাড়াও বিভিন্ন পরিত্যক্ত জলাশয় ও ফোয়ারায় জন্মাচ্ছে এডিস মশা। এসব স্থানকে মশার প্রজননক্ষেত্র বলে মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার জন্য সিসিকের প্রতি জোর দাবী জানান তারা।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা সূত্রে জানা গেছে, সিটি কর্পোরেশনে প্রয়োজনীয় পরিচ্ছন্নতাকর্মী নেই। যা আছেন তা খুবই অপ্রতুল। এছাড়া ৪২টি ওয়ার্ডের মধ্যে পুরোনো ২৭টি ওয়ার্ডেই বর্তমানে নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এর বাইরে বর্ধিত নতুন ১৫টি ওয়ার্ডে এখনো পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়নি। পুরোনো ২৭ টি ওয়ার্ডে মোট ৪৭৬ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী কাজ করছেন। অথচ নগর নিয়মিত পরিচ্ছন্ন রাখতে সব মিলিয়ে অন্তত সাড়ে ৭শতাধিক পরিচ্ছন্নতা কর্মী প্রয়োজন।
সিসিকের পরিচ্ছন্নতা শাখার প্রধান হানিফুর রহমান বলেন, পরিচ্ছন্নতা সেক্টরে লোকবলের তীব্র সংকট রয়েছে। এরপরও সীমিত জনবল নিয়ে নিয়মিত ময়লা-আবর্জনা অপসারণে কাজ চলছে। প্রতিদিনই বর্জ্য অপসারণ করা হয়। তবে বর্তমানে ডেঙ্গু প্রতিরোধে এডিসের লার্ভার অনুসন্ধানে অভিযান ও পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম আরো জোরদার করা হয়েছে।
সিসিকের স্বাস্থ্যবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, নগরীতে এডিসের লার্ভা পাওয়ার বিষয়টি উদ্বেগজনক। প্রয়োজনীয় লোকবল সংকটে মশার লার্ভা ধ্বংসে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছেনা। কর্পোরেশনে কোন কীটতত্ত্ববিদ নেই। এ ছাড়া মশকনিধনকর্মী রয়েছেন মাত্র তিনজন। তবে প্রতিদিন দৈনিক মজুরিতে ৪০ জন কর্মী নিয়োগ দিয়ে প্রতিদিন ৬টি স্থানে মশকনিধনের জন্য স্প্রে ও ফগার মেশিন দিয়ে মশক নিধন কার্যক্রম চলছে। এছাড়াও ১২ জন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিদিন নগরীর বিভিন্ন স্থানে এডিসের লার্ভার অনুসন্ধান করছে। এখন পর্যন্ত নগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডেই এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. জাহিদুল ইসলাম দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও মশক নিধনে শনিবার থেকে নগরীর পুরনো সবকটি ওয়ার্ডে একযোগে মশক নিধনের ওষুধ ছিটাতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সচেতনতা তৈরিতে মাইকিংয়ের পাশাপাশি প্রচারপত্রও বিতরণ কার্যক্রম চলছে। ইতোমধ্যে গতকাল শনিবার থেকে ওয়ার্ডভিত্তিক দৈনিক মজুরীতে ১০ জন করে লেবার কাজ শুরু করেছে। এর পরিধি আরো বাড়ানোর পরিকল্পনা চলছে। সিসিকের অভিযানের পাশাপাশি নগরবাসীকে নিজ থেকে সচেতন হতে হবে। বাসা-বাড়ীর আঙ্গিনা পরিস্কার রাখতে হবে।
তিনি বলেন, পুরনো ২৭টি ওয়ার্ডে এডিসের লার্ভা পাওয়া গেছে। বর্ধিত ওয়ার্ডের অধিকাংশ এলাকা ঘনবসতিপূর্ণ। ফলে সেসব এলাকায় অভিযান পরিচালনা করতে বিপুল পরিমান লোকবল প্রয়োজন। তবে কুচাই, টুকেরবাজার ও মেজরটিলা (ইসলামপুর) এলাকাসহ বর্ধিত এলাকাগুলোতে এডিসের লার্ভা থাকতে পারে।
এ ব্যাপারে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, প্রয়োজনীয় জনবল না থাকায় একযোগে ৪২টি ওয়ার্ডে মশকনিধন কিংবা পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করা যাচ্ছেনা। ফলে কার্যকর ফল মিলছেনা। কারণ এক ওয়ার্ডে ওষুধ ছিটালে কিংবা নালা-নর্দমা-জলাধারে পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করলে ঐ ওয়ার্ডের মশা উড়ে পাশের অন্য ওয়ার্ডে বা নালা-নর্দমায় গিয়ে বংশবিস্তার ঘটাচ্ছে। তাই একযোগে সবকটি ওয়ার্ডে মশকনিধনে অভিযান পরিচালনা করার পাশাপাশি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে করণীয় নির্ধারণ করতে আগামী সোমবার দুপুরে সিটি কর্পোরেশনের পরিষদের সভা ডাকা হয়েছে। এই সভায় কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হবে।
তিনি বলেন, মশকনিধনে সিটি কর্পোরেশন সবসময়ই ওষুধ ছিটিয়ে আসছে। এর মধ্যে দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় নগরে প্রতিদিনই মশার ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। পাশাপাশি এডিসের লার্ভা অনুসন্ধানের কাজ চলছে। তবে এসব কাজে লোকবল কম থাকলেও দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কর্মী নিয়োগ দিয়ে ওষুধ ছিটানোর কাজ পরিচালনা করা হচ্ছে। প্রয়োজনে লোকবল আরও বাড়ানো হবে। হঠাৎ ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার বিষয়টিকে আলাদাভাবে গুরুত্ব দিয়ে আমরা কাজ করছি। আমি নিজেও প্রতিদিন বিভিন্ন স্থানে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে অভিযান পরিচালনা করছি। এডিসের লার্ভা পাওয়ায় ভবনমালিক এবং সংশ্লিষ্টদের জরিমানা করছি। অভিযান আরো জোরদার হয়েছে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সিটি কর্পোরেশনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। পাশাপাশি নগরবাসীকেও সচেতন হতে হবে। বাসা-বাড়ীর আঙ্গিনা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। সম্মিলিতভাবে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।