সিলেটে ফের শিশু টিকার সংকট
প্রকাশিত হয়েছে : ০২ জানুয়ারি ২০২৪, ২:০০:৫৪ অপরাহ্ন
এমজেএইচ জামিল : সিলেটে ফের শিশু টিকার সংকট দেখা দিয়েছে। নগরীর গত ১ মাস থেকে নগরীর ইপিআই টিকা কেন্দ্রগুলোতে মিলছেনা পিসিভি’র টিকা। তবে আগামীর ১৫ দিনের মধ্যে টিকার সংকট কেটে যাবে বলে জানিয়েছেন সিসিকের স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট বিভাগ। এর আগে গত বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসেও নগরীতে টিকা সংকট দেখা দিয়েছিল। তখন টিকার সরবরাহ স্বাভাবিক হতে আড়াই প্রায় আড়াই মাস লেগেছিল।
নগরীর ভাতালিয়ার বাসিন্দা সাবিনা বেগম (২৫) তার নবজাতক বাচ্চার বয়স ৫০ দিন অতিবাহিত হয়েছে। ৬ সপ্তাহ অর্থাৎ ৪২ দিন পর তার শিশুকে পেন্টা ও পিসিভি টিকা দেয়ার কথা। স্বাস্থ্য সচেতন অভিভাবক হিসেবে গত ২ সপ্তাহ থেকে নগরীর বিভিন্ন ইপিআই-টিকাদান কেন্দ্রে বাচ্চাকে নিয়ে ঘুরছেন। কয়েক দফায় নগরীর ৩টি টিকাদান কেন্দ্রে গিয়েও টিকা না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে আসেন তিনি।
শুধু সাবিনা নয়, এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন নগরীর শত শত অভিভাবক। শিশুদের সময়মতো টিকা দিতে না পারায় স্বাস্থ্য সচেতন অভিভাবকগণ হতাশায় ভুগছেন।
এদিকে ইপিআই-টিকাদান কেন্দ্রের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন গত ১৫ দিন থেকে নগরীতে পিসিভি’র টিকা সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। ফলে স্টকে থাকা টিকা ইতোমধ্যে শেষ হয়ে যাওয়ায় কিছু টিকা তারা দিতে পারছেন না। এ নিয়ে প্রতিদিনই অভিভাবকদের সাথে টিকাদান কেন্দ্রের স্টাফদের বাক-বিতন্ডার ঘটনা ঘটছে।
শিশুদের টিকার সঙ্কট থাকার কথা স্বীকার করে স্বাস্থ্য বিভাগ সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন এমন পরিস্থিতি শুধু সিলেট নয়, সারাদেশেই। এসব টিকা বিদেশ থেকে আমদানী করতে হয়। ১৫ দিনের মধ্যে শিশুদের সবধরনের টিকাদান কার্যক্রম স্বাভাবিক হবে।
জানা গেছে, সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির আওতায় জন্মের পর থেকে ২৩ মাস বয়সের মধ্যে শিশুদেরকে ১০টি বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক টিকা দেওয়া হয়। সিলেটে গত ২ মাস ধরে শিশুদের পিসিভি টিকার সংকট দেখা দিয়েছে। প্রতিদিন সরকারি হাসপাতালসহ বিভিন্ন কেন্দ্রে গিয়ে টিকা না পেয়ে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন শিশুদের মা ও স্বজনেরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) আওতায় জন্মের পর থেকে ২৩ মাস বয়সের মধ্যে ১০টি বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক হিসেবে শিশুদের ৭ ধরনের টিকা দেওয়া হয়। টিকাগুলো হলো বিসিজি, ওপিডি বা পোলিও, আইপিভি, পিসিভি, পেন্টা ভ্যালেন্ট, এমআর-১ ও এমআর-২। কিন্তু গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে সিলেটে পিসিভি টিকা পাওয়া যাচ্ছে না। বাকী আরো দুয়েকটি টিকার স্টক শেষ হওয়ার পথে।
সিসিকের ইপিআই সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিন নগরীর বিভিন্ন হাসপাতাল ও ইপিআই-টিকাদান কেন্দ্রে ৪২টি ওয়ার্ডের ৫০ থেকে ১০০ শিশুকে নিয়ে অভিভাবকেরা টিকা দিতে আসছেন। অনেকে আছেন যাঁরা চার-পাঁচবার এসে ফিরে গেছেন। সাধারণত জন্মের পর শিশুর বয়স ৪৩ দিন পূর্ণ হলে প্রথম ডোজ দেওয়া হয়। এরপর বিভিন্ন মেয়াদে ২৩ মাসের মধ্যে শিশুদের এসব টিকা দিতে হয়। নগরীর টিকাকেন্দ্রগুলোতে ১ বছরে গড়ে ৩০-৪০ হাজার শিশুকে টিকা দেওয়া হয়।
নগরীর একটি ইপিআই কেন্দ্রের টিকা প্রদানকারী সিনিয়র স্টাফ নার্স বলেন, এই কেন্দ্রে প্রতিদিন গড়ে ৫-১০ জন করে টিকা নিতে আসেন। টিকা নেই বললে অভিভাবকেরা ক্ষেপে যান। সব ক্ষোভ আমাদের ওপর ঝাড়েন। কারণ, অনেক দূরদূরন্ত থেকে রিকশা ভাড়া খরচ করে তাঁরা আসেন। তিনি বলেন, অভিভাবকদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছুই নয়। কারণ, ২৩ মাসের ভেতর টিকা দিতে পারলেই হয়।
জানা গেছে, সংক্রামক রোগে শিশু মৃত্যুহার কমানোর জন্য টিকা দেওয়া হয়। এদিকে টিকাসংকটের কারণে প্রতিনিয়ত অভিভাবকদের তোপের মুখে পড়তে হচ্ছে স্বাস্থ্য বিভাগের মাঠকর্মীদের। কয়েকজন মাঠকর্মী জানান, গত ১৫ দিন ধরে নগরীতে পিসিভি টিকার সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। নগরীর থেকে শুরু করে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনার কার্যালয় এবং জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে যোগাযোগ করার পর তাঁদের জানানো হয়, এই সংকট এখন সারা দেশে।
জানা গেছে, সিলেট জেলায় প্রতি বছর ৯০ হাজারের অধিক শিশুকে ১০টি টিকা দেয়া হয়। এরমধ্যে শিশু ৬ সপ্তাহ হলে আইপিভি টিকার প্রথম ডোজ ও ১৪ সপ্তাহ বয়সে ২য় ডোজ দিতে হয়। একই সময়ে পেন্টাভ্যালেন্ট (ডিপিটি, হেপাটাইটিস-বি, হিব), ওপিভি এবং পিসিভি টিকার ১ম ডোজ দিতে হয়। তারপর কমপক্ষে ৪ সপ্তাহ/২৮ দিনের ব্যবধানে এ সকল টিকার ২য় এবং ৩য় ডোজ দিতে হয়। শিশুর ২৭০ দিন পূর্ণ হলেই শিশুকে ১ম ডোজ এবং ১৫ মাস বয়স পূর্ণ হলেই ২য় ডোজ এমআর (হাম ও রুবেলা) টিকা দিতে হয়।
সিসিকের ইপিআই সূত্রে জানা গেছে, নগরীর ৪২টি ওয়ার্ডের ২৪৩টি ইপিআই কেন্দ্রে প্রতিবছর ১৮ হাজারের মতো শিশুকে ১০টি টিকা দেয়া হয়। ফলে নগর এলাকার জন্য বছরে ৫১ হাজার ডোজ পিসিভি, ৫১ হাজার ডোজ পেন্টা, ৫১ হাজার ডোজ ওপিভি, ৩৪ হাজার ডোজ আইপিভি, ৩৪ হাজার ডোজ এম আর, ১৭ হাজার ডোজ ভিসিজি টিকার চাহিদা থাকে। কিন্তু গত ১৫ দিন ধরে পিসিভি টিকার সঙ্কট দেখা দিয়েছে, পাশাপাশি আরো কয়েকটি টিকার মজুদও শেষ হওয়ার পথে। অনেকেই টিকাদান কেন্দ্রে এসে টিকা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছে।
কেন্দ্রগুলোয় পিসিভি টিকার সংকটের কথা স্বীকার করেন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. জাহিদুল ইসলাম। তিনি দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, গত ১৫ দিন ধরে নগরীর টিকা কেন্দ্রগুলোতে ইপিআই টিকার সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। ফলে এই মুহুর্তে পিসিভি’র ডোজ দেয়া যাচ্ছেনা। বর্তমানে অন্যান্য টিকার সরবরাহ থাকলেও আরো দুয়েকটি টিকার স্টকও শেষ হওয়ার পথে। শীঘ্রই টিকা আসছে বলে আমাদেরকে জানানো হয়েছে। আশা করছি আগামী ১৫ জানুয়ারীর মধ্যে সরবরাহ স্বাভাবিক হবে।
এ ব্যাপারে সিলেটের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. জন্মেজয় শংকর দত্ত দৈনিক জালালাবাদকে জানান, শিশুদের পিসিভি টিকার সঙ্কট বলা ঠিক হবেনা। এটা সাময়িক ঘাটতি। এমন অবস্থা শুধু সিলেট নয়, সারাদেশেই। নগরীতে পিসিভি টিকার সংকট থাকলেও উপজেলা পর্যায়ে এই টিকার সংকটের কোন তথ্য আমাদের হাতে নেই। এছাড়া বছরের শুরুতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আমাদেরকে টিকার বার্ষিক চাহিদা প্রেরণ করতে হয়। এবারও আমরা চাহিদা প্রেরণ করেছি। শীঘ্রই নগর এলাকায় পিসিভি টিকার সরবরাহ স্বাভাবিক হবে। এ নিয়ে চিন্তার কোন কারণ নেই।