সুরমা এখন মরা গাঙ
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ মার্চ ২০২৪, ৭:০৩:৩৬ অপরাহ্ন
৩২ কিলোমিটারে জেগেছে শতাধিক চর
বছরে আট মাস থাকে না পানি
এ টি এম তুরাব :
সিলেটের উত্তর-পূর্ব সীমান্তের নদী সুরমা। দেশের দীর্ঘতম নদীটি নাব্যতা সংকটে পড়েছে। যে নদীতে একসময় চলতো জাহাজ, সেই সুরমা এখন কোনোমতেই চলছে নৌকা। বছরের আট মাসই নদীতে থাকে না পানি। পলি জমে পরিণত হয়েছে খেলার মাঠে। জেগেছে বিশাল চর। উৎসমুখ থেকে ৩২ কিলোমিটারের মধ্যে জেগেছে অন্তত ১০০টি চর। ক্রমশ মরা নদীতে পরিণত হচ্ছে সুরমা। এই অবস্থায় পানির অভাবে সিলেট অঞ্চলের বাসিন্দারা বিশেষত কৃষি ও মৎস্যজীবীরা পড়ছেন বিপাকে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায় সিলেট নগরীর কুশিঘাট থেকে কাজিরবাজার হয়ে টুকেরবাজার পর্যন্ত সুরমা নদীর উল্লিখিত হতশ্রী চেহারা চোখে পড়েছে। তবে সীমান্তবর্তী জকিগঞ্জ এলাকা থেকে সুনামগঞ্জের শেষ সীমা পর্যন্ত কমবেশি এমন চিত্রই দেখা যাবে।
জানা যায়, উজানে ভারত থেকে নেমে আসা বাংলাদেশের সীমান্ত জকিগঞ্জের বরাক মোহনায় এর উৎপত্তি। সেখান থেকে ভাগ হয়ে বাংলাদেশে প্রবাহমান দুই নদী সুরমা ও কুশিয়ারা। সুরমা কানাইঘাট, গোলাপগঞ্জ, সিলেট নগর, সদর উপজেলা ও সুনামগঞ্জের উপর দিয়ে প্রবাহিত। ২৪৯ কিলোমিটার বা ১৫৫ মাইল দৈর্ঘ্যের নদীটি সুনামগঞ্জ জেলার বাউলাই নদীর মোহনায় মিশেছে। বর্ষায় বন্যাপ্রবণ সুরমায় শীতে দেখা দেয় নাব্যতা সংকট। শীত মৌসুমে পরিণত হয় মরাগাঙে। সুরমার স্থানে স্থানে এখন বিশাল চর। কোথাও কোথাও সবজি ফলিয়েছেন স্থানীয়রা। আবার কোথাও বিকেল হলে চরে বসে জমজমাট ফুটবল ও ক্রিকেট ম্যাচ। তখন শিশু-কিশোরদের হইহুল্লোড়ে চর এলাকা প্রাণবন্ত। তবে প্রাণহীন দেশের অন্যতম দীর্ঘ নদী সুরমা। চরসহ বিভিন্ন স্থানে প্লাস্টিকসহ আবর্জনার স্তূপ দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এ অবস্থায় উদ্বিগ্ন বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদীরা। তারা বৃহত্তর পরিকল্পনার আওতায় থমকে থাকা খননকাজ সম্পন্ন করার তাগিদ দিচ্ছেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) তথ্য মতে, বাংলাদেশ ভ‚খÐে প্রবেশের পর নদীর প্রথম ৩২ কিলোমিটারে ১০০টির বেশি চর পড়েছে। আসামের অমলসিদেও পলি জমে অনেকটা ভরে যাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে উৎস বরাক থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে সুরমা। এ অবস্থা চলতে থাকলে একসময়ের বহতা ¯্রােতস্বিনী সুরমা নদী একদিন হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন নদী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত এক যুগে চার দফায় নদীটি খননের উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাস্তব কাজ হয়েছে কমই। ২০১৯ ও ২০২১ সালে দুটি সমীক্ষা চালানো হয়। তারও আগে ২০১৭ সালে একটি ধারণাপত্র ও ২০১২ সালে খননের একটি প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠায় পাউবো। ২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যায় সিলেটের ১১টি উপজেলা আক্রান্ত হয়। ডুবে যায় খোদ সিলেট নগরের অর্ধেকের বেশি এলাকা। নদী খননের দাবি নতুন মাত্রা পায়। এরপর ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে সুরমা নদীর ১৮ কিলোমিটার অংশে খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কাজটি ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে শুরু হয়ে সে বছরেরই জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা ২০২৪ সালের ফেব্রæয়ারির শেষ প্রান্তে এসেও চলছে। খননকাজের ধীরগতি নিয়ে জাতীয় সংসদে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। ২০২৩ সালের ২১ জানুয়ারি খননকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন তিনিই। দ্বিতীয় মেয়াদে চলতি বছরের জুনে খননকাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। তবে তা সময়মতো শেষ হবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তা ছাড়া নদীর উৎসমুখ বন্ধ থাকলে মাঝখানে এই খনন কতটা ফল দেবে তা-ও অনিশ্চিত।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, উৎসমুখ ভরাট হয়ে যাওয়ায় বর্ষকালে বরাক থেকে আসা পানির মাত্র ৫ থেকে ১০ শতাংশ সুরমায় প্রবেশ করে। আর অন্যান্য মৌসুমে পানি প্রবেশ করে না বললেই চলে, সব পানি চলে যায় কুশিয়ারায়। ফলে বছরের প্রায় আট মাসই পানিশূন্য থাকে সুরমা।
সুরমায় চলমান খননকাজ জুনের মধ্যে শেষ হবে জানিয়ে তিনি আরো বলেন, এরই মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। জুনের মধ্যে শতভাগ কাজ শেষ হবে বলে আশা করি। সিলেট নগরের কুশিঘাট এলাকা থেকে সদর উপজেলার জাঙ্গাইল পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে পাঁচটি প্যাকেজে কাজ চলছে বলে জানান তিনি। ১৮ কিলোমিটার অংশে খনন করে কী উপকার হবে এই প্রশ্নের জবাবে দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, এটা সাময়িক সমাধান। এতে সুরমার এ অংশে পানির ধারণক্ষমতা একটু বাড়বে।