সরকারী ও বেসরকারী চাকরীর ক্ষেত্রে বৈষম্য প্রসঙ্গে
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৩০:৫৫ অপরাহ্ন
সম্প্রতি দেশের একটি শীর্ষ দৈনিকে ‘তারা পাবেন মহার্ঘ ভাতা, অন্যরা কি টিসিবি ট্রাকের লাইনে দাঁড়াবে’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সব সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীয়কে মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এখন সরকারী ব্যক্তিবর্গের বাইরের মানুষদের কী হবে? বলা বাহুল্য, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির জন্য রাষ্ট্র বেতনের সঙ্গে অতিরিক্ত যে ভাতা প্রদান করে তা মহার্ঘ ভাতা হিসেবে পরিচিত।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোঃ মোখলেসুর রহমান জানান, একটি পে কমিশন গঠন সময়সাপেক্ষ বিষয়। তাই সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সর্বস্তরের কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হবে। কর্মরতদের পাশাপাশি অবসরে যাওয়া কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাও এবার মহার্ঘ ভাতার সুবিধা পাবেন। কত শতাংশ ভাতা দেওয়া হবে, তা নির্ধারণ করতে কমিটিও গঠন করা হয়েছে। জানা গেছে, সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা যাতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে দেওয়া যায় তা নিয়ে কাজ চলছে।
অনেকের মতে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার ব্যাপারে যেসব যুক্তি দিয়েছেন, তা অগ্রাহ্য করার মতো নয়। প্রতি বছরই নিত্যপণ্যের দাম ও সংসারের অন্যান্য খরচ বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে সরকারী কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিদের মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার প্রস্তাব যৌক্তিক।
অবশ্য বিগত স্বৈরাচারী হাসিনার শাসনামলে আওয়ামী লীগ সরকার অযৌক্তিক সুবিধা দিয়েও সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের খুশী করতে চেয়েছে, বিশেষ করে সরকারী কর্মকর্তাদের বিনা সুদে গাড়ির ঋণ ও গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মাসিক ভাতা দিয়েছে। এছাড়া সরকার হঠাৎ করেই বাংলা নববর্ষ উপলক্ষেও একটা ভাতা দেয়া শুরু করে। এভাবে সরকার নববর্ষের ভাতা দিয়ে সরকারী ও বেসরকারী কর্মীদের সুযোগ সুবিধার পার্থক্য আরো বাড়িয়ে দেয়। সরকার জনগণের করের অর্থে সরকারী কর্মচারীদের ভাতা দিলো। কিন্তু বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মী ও শ্রমিকেরা কেউ ভাতা পেলেন না। এতে বৈষম্য আরো বেড়ে গেলো। এর মধ্যে দিয়ে উৎসব উদযাপনকেও দুইভাগে ভাগ করে ফেলা হলো।
বলা বাহুল্য, ২০১০ সালে সর্বশেষ বেতন কাঠামো ঘোষণা করা হয়, যাতে সরকারী কর্মচারীদের বেতন ভাতা দ্বিগুণ করা হয়েছিলো। তখন বলা হয়েছিলো, সরকারী কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা বাড়লে তারা দুর্নীতিতে জড়াবেন না। বৈধ উপার্জন দিয়েই স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে পারবেন। কিন্তু গত ৯ বছরের অভিযোগ হলো, সরকারী অফিসে ঘুষ ও দুর্নীতি আরো বেড়েছে। আগে সরকারী কর্মকর্তারা যে হারে ঘুষ নিতেন, ২০১৫ সালের পর হারটা তারা বাড়িয়ে দিয়েছেন।
সচেতন মহলের মতে, জনপ্রশাসন সচিব মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার পক্ষে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার দোহাই দিয়েছেন। কিন্তু জীবনযাত্রার ব্যয় তো কেবল সরকারী কর্মীদের বাড়েনি, দেশের সব নাগরিকেরই বেড়েছে।
এ প্রসঙ্গে সরকারী কর্মকর্তাদের বক্তব্য হচ্ছে, একজন সিএনজি চালক, রাজমিস্ত্রি, হেলপারও মাসে ৩০ হাজার টাকা আয় করেন। একজন ২০ গ্রেডের সরকারী কর্মচারী কি সিএনজি চালক, রাজমিস্ত্রি, হেলপার, দিনমজুরের চেয়েও খারাপ জীবন যাপন করবে? তাহলে রাষ্ট্রের এই পদে কে চাকরী করতে আসবেন? রাষ্ট্র কি চায় কম বেতনের চাকরীজীবীরা দুর্নীতির মাধ্যমে জীবনযাপন করুক?
কথা হচ্ছে, সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীদের সবাই সমান সুবিধাভোগী নন। নিচের গ্রেডের কর্মচারীদের পক্ষে সরকারী বেতনভাতায় চলা যে মুশকিল, এতে কোন সন্দেহ নেই। তা সত্বেও তাদের সৌভাগ্য যে, তারা একটি কাজে আছেন এবং নির্দিষ্ট অর্থ পাচ্ছেন মাস শেষে। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই অবৈধ ও অন্যায় হলেও সত্য বিষয় কম-বেশী উপরি বা ঘুষ পাবার সুযোগ রয়েছে তাদের। আর উপরের লেভেলের আমলা কর্মকর্তাদের কথা বলাই বাহুল্য। অনেকে শত কোটি নয়, হাজার কোটি টাকারও মালিক। অপরদিকে ১৭ লাখ সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীদের আয়ের কমবেশী উপায় থাকলেও কোটি কোটি মানুষ এখনো বেকার কিংবা অর্ধবেকার। আর বেসরকারী চাকরী কিংবা অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত তাদের সবার আয়ও সংসার চালানোর মতো যথেষ্ট নয়। কেউ কেউ মাসে ৩০/৪০ হাজার টাকা রোজগার করলেও বেশীর ভাগের পক্ষেই ১৫/২০ হাজার এমনকি ১০/১২ হাজার টাকাও রোজগার করা সম্ভব হচ্ছে না। সরকার সরকারী কর্মচারীদের বেতন ভাতা বৃদ্ধি করলেও বেসরকারী চাকরীজীবী ও জনগণের আর্থিক অবস্থার উন্নতি বা আর্থিক সহায়তা দেয়ার কেউ নেই। এ পর্যন্ত সরকার তাদের কি যথেষ্ট সাহায্য সহযোগিতা করেছে বা করার কোন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, এমন প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই এখন জাগছে।
যা-ই হোক, সরকারী কিংবা বেসরকারী চাকরীজীবী এবং কর্মহীন কিংবা অর্ধবেকার নির্বিশেষে সকল জনগণের আর্থিক সংকট ও অভাব দুরীকরণে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্ব দিতে হবে, পদক্ষেপ নিতে হবে। অতীতের স্বৈরাচারী শাসনামলের মতো সৎ পিতামাতাসুলভ তথা বৈষম্যমূলক নীতি পরিত্যাগ করে গোটা দেশের জনগণের জীবনযাপন উন্নয়নে কাজ করতে হবে। এমন প্রত্যাশা ও দাবি দেশবাসীর।