ঈদে সিলেটে রেকর্ডসংখ্যক পর্যটকেও হয়নি কাঙ্খিত ব্যবসা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ এপ্রিল ২০২৫, ৩:৩৭:০৭ অপরাহ্ন
এমজেএইচ জামিল : প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপার লীলাভূমি সিলেট। এখানে বেড়ানোর জায়গার যেন শেষ নেই। পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্নার স্বচ্ছ পানি ও উঁচু-নিচু পাহাড়ে ঘেরা পাহাড়ের ঢেউ খেলানো চা-বাগান নিমিষেই পর্যটকের মন কেড়ে নেয়। নগরের লাক্কাতুড়া, মালনিছড়া, তারাপুর ও দলদলি চা বাগানে স্থানীয় ও দেশি-বিদেশি পর্যটকরা পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন আনন্দ খুশিতে।
ঈদের লম্বা ছুটিতে সিলেটে পর্যটকের ঢল নামলেও কাঙ্খিত ব্যবসা হয়নি বলে জানিয়েছেন পর্যটন সংশ্লিষ্টরা। পর্যটনস্পট গুলোতে স্থানীয় পর্যটকদের উপস্থিতি বেশী হওয়ায় অভিজাত তথা প্রথম সারির হোটেল গুলোতে আশানুরুপ পর্যটকের দেখা মিলেনি। ফলে প্রস্তুতি থাকা স্বত্তেও কাঙ্খিত ব্যবসা না হওয়ায় আক্ষেপ হোটেল-মোটেল ব্যবসায়ীদের।
এবারও ঈদুল ফিতরের ৯ দিনের লম্বা ছুটিতে সিলেটে পর্যটকের ঢল নামে। মুখরিত হয়ে উঠে সিলেটে পর্যটন স্পটগুলো। প্রাকৃতিক পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে ছিল উপচে পড়া ভিড়। স্বপরিবারে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে সিলেটে ছুটে আসেন ভ্রমণপিপাসুরা। পাহাড়, স্বচ্ছ নীল জলরাশি আর পাথরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে সিলেটে এবার ঢল নামে কমবেশ ১০ লাখ পর্যটকের। ব্যাপক উপস্থিতির কারণে নগরীর সাধারণ মানের হোটেল-মোটেলগুলোতে খালি ছিলনা কোন রুম। এছাড়া মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের পর্যটনস্পটগুলোও ছিল লোকে লোকারণ্য। তবে এই সময়ে সিলেটসহ স্থানীয় পর্যটকের সংখ্যাই বেশি ছিলো।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঈদের দিন থেকে শুরু করে শনিবার (৫ এপ্রিল) পর্যন্ত পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে দর্শনার্থীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। নগরীর বাহিরে গোয়াইনঘাট উপজেলায় রয়েছে সবচেয়ে বেশি পর্যটনকেন্দ্র। আর ঈদের ছুটিতে এতে যেন প্রাণ ফিরে পায় উপজেলার সবকটি পর্যটনকেন্দ্র। এই সময়ে নগরীর চা বাগানসহ বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে মেঘ-পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করেন দর্শনার্থীরা।
গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং, বিছনাকান্দি, সোয়াম ফরেস্ট রাতারগুল ছাড়াও পানতুমাই ঝরনা, জাফলং চা বাগান ও মায়াবী ঝরনা পর্যটকদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। পাশাপাশি মুখরিত হয়ে উঠে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সাদাপাথর পর্যটন স্পট।
পর্যটকদের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান পাহাড়, পাথর আর স্বচ্ছ জলের সমাহার দেখে তাঁরা বিমোহিত হয়েছেন। পরিবার-পরিজন বা বন্ধুবান্ধব নিয়ে তারা এসেছেন প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে।
এদিকে এবারও ঈদের ছুটিতে পর্যটনস্পটগুলোতে নানা অব্যবস্থাপনা চোখে পড়েছে। এতে ভোগান্তির শিকার হয়েছেন পর্যটকরা। উপচেপড়া ভিড় থাকায় কোম্পানীগঞ্জের সাদাপাথরে নৌকা পেতে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে পর্যটকদের। টুরিস্ট পুলিশের স্থায়ী ক্যাম্প না থাকায় পর্যটকদের নিরাপত্তায় থানা পুলিশ ও আনসার সদস্যদের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। তাছাড়া গাড়ি পার্কিং এরিয়ায় ছোট বড় গর্তে পানি জমে থাকায় ভোগান্তি পোহাতে হয় গাড়ি চালকদের।
জাফলং, সাদাপাথর ছাড়াও বিছনাকান্দি, রাতারগুল সোয়াম ফরেস্ট, পানতুমাই ঝরনা, লালাখাল ও সিলেটের বিভিন্ন চা বাগানে সোমবার ঈদের দিন থেকেই পর্যটকদের ঢল নামে। সিলেটের সাধারণ মানের বেশির ভাগ হোটেল-রিসোর্ট ছিল অতিথিতে পরিপূর্ণ। তবে অভিজাত ও প্রথম সারির হোটেল-রিসোর্টে কাঙ্খিত অতিথির উপস্থিতি হয়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সিলেট শহর থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে সাদাপাথর। সাদা পাথুরে নদীর শীতল জল আর পাশেই দিগন্ত বিস্তৃত মেঘালয় পাহাড়। প্রকৃতির এ অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে সারাবছরই পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে। ঈদ মৌসুমে পর্যটক সমাগম আরও বাড়ে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ঈদের ছুটিতে সাদাপাথরে গিয়ে দেখা যায়, পর্যটকদের কারণে নদীতে পা ফেলার অবস্থা নেই। ভিড়ের কারণে অনেকে নদীর তীরে দাঁড়িয়ে ছিলেন; নামতে পারছিলেন না পানিতে। সাদাপাথর ঘুরতে আসা ঢাকার জিসান বলেন, ‘এই পরিবেশ অপরূপ। যে কেউ আসলে মন ভালো হয়ে যাবে।’
এদিকে ঈদের ছুটিতে বিভিন্ন পর্যটন স্পট সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পর্যটক দর্শনার্থীমুখর হয় উঠে জাফলং, বিছনাকান্দি, রাতারগুল। তবে বিছনাকান্দি রাতারগুলের তুলনায় পর্যটক উপস্থিতি বেশি ছিলো জাফলংয়ে। সবুজের আস্তরণে মেঘালয়ের বিস্তৃত চোখ জোড়ানো সবুজ টিলা, পাহাড়, বয়ে চলা স্বচ্ছ জলরাশি, নুড়িপাথরের কলতানের সৌন্দর্য অবলোকনের জন্য ভ্রমণে জাফলং ছুটে আসেন দর্শনার্থীরা। গ্রীস্মের তাপদাহেও প্রকৃতি প্রেমিরা ছুটে এসেছেন প্রকৃতির কাছাকাছি।
বরাবরের মতো এবারও এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে তাঁরা বিমুগ্ধ। পাহাড়,টিলার সাথে সাদা মেঘের লুকোচুরী। বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই প্রকৃতি যেন সেজেছে তার আপন মহিমায়। আগন্তকদের মধ্যে পরিবার-পরিজন আর বন্ধুবান্ধব নিয়ে ভ্রমণপিয়সীরা স্থানগুলো দর্শন করছেন। প্রতিটি স্পষ্টই লোকে লোকারন্য। প্রকৃতির এমন কাছাকাছি আসতে পেরে তারা খুশি। সোম-মঙ্গল-বুধ-বৃহস্পতি-শুক্র ও শনিবার দিনব্যাপী গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং, বিছনাকান্দি, সোয়াম ফরেস্ট রাতারগুল ছাড়াও পানতুমাই ঝর্ণা, জাফলং চা বাগান ও মায়াবী ঝর্ণাতেও পর্যটকদের পদচারণা ছিলো চোখে পড়ার মতো।
তবে সব চাইতে বেশি পর্যটকের ভিড় ছিল জাফলং জিরো পয়েন্ট। যাদের বেশিরভাগ দর্শনার্থীই ছিলেন উঠতি তরুণ-তরুণী। নদী, স্বচ্ছ জল, আর ভারতের মেঘালয়ের ওমঘট নদীর উপর ঝুলন্ত ব্রিজ, টিলা পাহাড়ের পাশাপাশি এখানকার খাসিয়া পল্লী, মায়াবী ঝরণাও মন কাঁড়ে ভ্রমণপ্রেয়সীদের। পর্যটক সমাগম বৃদ্ধি পাওয়ায় এখানকার হোটেল মোটেল রিসোর্টে কোন রুম খালি ছিলনা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, অগণিত পর্যটকরা আগেই ফোন ও অনলাইনে বুকিং দিয়ে রাখেন হোটেল মোটেল রিসোর্টের রুম সমুহ। জাফলং জিরো পয়েন্টের আশপাশের সবকটি খাবার হোটেল রেস্টুরেন্টের জমজমাট বিকিকিনি চোখে পড়ে। সেখানকার হোটেল রেস্টুরেন্টের মালিকরা জানান, পর্যটক, দর্শনার্থীদের সমাগম বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের হোটেল রেস্টুরেন্টের বিকিকিনি অনেকটা বেড়েছিল।
এ ব্যাপারে সিলেট হোটেল এন্ড গেস্ট হাউস ওনার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক গোলাম কিবরিয়া দৈনিক জালালাবাদকে জানান, এবার সিলেটে রেকর্ড সংখ্যক পর্যটকের সমাগম ঘটলেও আমাদের কাঙ্খিত ব্যবসা হয়নি। স্ট্যান্ডার্ড মানের হোটেল গুলোতে শতভাগ রুম বুকিং হয়নি। মধ্যম মানের হোটেল গুলোতেও কিছু রুম খালি ছিল। এছাড়া পর্যটনস্পট গুলোতে এবার স্থানীয়দের উপস্থিতি বেশী ছিল।
তিনি বলেন, ভারতের সাথে ভিসা বন্ধ এবং বিমান ভাড়াও তুলনামূলক কম থাকায় আমরা এবার আরো বেশী বাহিরের পর্যটকদের উপস্থিতি প্রত্যাশা করেছিলাম। সেই অনুপাতে প্রস্তুতিও নেয়া হয়েছিল। কিন্তু আশানুরুপ ব্যবসা হয়নি।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মোঃ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, এবারের ঈদের ছুটিতে সিলেটে ব্যাপক পর্যটকের আগমন ঘটেছে। পর্যটক বরণে জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশ, ট্যুরিস্ট পুলিশ, বিজিবি ও স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন সার্বক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। যেকোন ধরণের অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি ঠেকাতে আমাদের পক্ষ থেকে পর্যটন এলাকায় বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এবার সিলেটে আসা পর্যটকগণ নির্বিঘেœ অবকাশ যাপন করতে পেরেছেন।