শিক্ষার্থীর সাফল্যে অভিভাবকের শিক্ষা ও অর্থনৈতিক ভূমিকা
প্রকাশিত হয়েছে : ১১ মে ২০২৫, ৮:১২:৪৮ অপরাহ্ন
সাখাওয়াত হোসেন : শিক্ষা কেবল একটি ব্যক্তিগত অর্জন নয়—এটি একটি জাতির সামগ্রিক অগ্রগতির মূলভিত্তি। একজন শিক্ষার্থীর একাডেমিক সাফল্যে তার বিদ্যালয় যেমন ভূমিকা রাখে, তেমনি তার পরিবার—বিশেষ করে অভিভাবকের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও আর্থিক অবস্থা—অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সমাজে এখনো পরিবারকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা সক্রিয়, যেখানে অভিভাবকরা সন্তানের শিক্ষাজীবনে নির্দেশক ও সহায়কের ভূমিকা পালন করেন।
শিক্ষিত অভিভাবকেরা সাধারণত সন্তানদের পড়াশোনার প্রতি মনোযোগী হন। তারা কেবল বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে দায়িত্ব শেষ করেন না, বরং নিয়মিত খোঁজখবর রাখেন, পড়াশোনার অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করেন এবং শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। তাদের এই সচেতনতা ও সহযোগিতা সন্তানের মাঝে আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং ফলাফলে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। তারা সন্তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে পড়াশোনায় অনুপ্রাণিত করেন, সময়ানুবর্তিতা শেখান এবং পাঠ্যবইয়ের বাইরেও জ্ঞানচর্চার প্রতি আগ্রহী করে তোলেন।
অন্যদিকে যারা তুলনামূলকভাবে কম শিক্ষিত, তারা অনেক সময় সন্তানদের একাডেমিক সহায়তা দিতে পারেন না। অনেকেই পাঠ্যসূচি বা বিদ্যালয়ের কার্যক্রম সম্পর্কে সঠিকভাবে অবগত নন। ফলে সন্তানরা পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়লেও অনেক সময় তা নির্ধারিত সময়ে ধরা পড়ে না। তবে এখানে বলে রাখা দরকার, অনেক কম শিক্ষিত অভিভাবকও আন্তরিকতা ও শ্রম দিয়ে সন্তানকে আগলে রাখেন এবং তাদের সফল করে তোলেন। এই আন্তরিকতা প্রশংসনীয়, কিন্তু নির্দিষ্ট জ্ঞান ও দিকনির্দেশনার অভাব তাদের সীমাবদ্ধ রাখে।
আর্থিক অবস্থাও শিক্ষার্থীর পড়াশোনায় বড় ভূমিকা রাখে। যারা আর্থিকভাবে স্বচ্ছল, তারা সন্তানদের প্রয়োজনীয় বইপত্র, ইউনিফর্ম, টিউটর কিংবা কোচিংয়ের খরচ নির্বিঘ্নে বহন করতে পারেন। ফলে এসব শিক্ষার্থী পড়াশোনায় বাড়তি সুবিধা পায়। অনেক সময় তারা শিক্ষার পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমেও অংশ নিতে পারে, যা তাদের মানসিক ও ব্যক্তিত্বগত বিকাশে সহায়তা করে। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা পরিবারের সন্তানরা অনেকক্ষেত্রে এসব সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। কখনো কখনো পরীক্ষার ফি বা শিক্ষা উপকরণ জোগাড় করতেও তাদের বেগ পেতে হয়, যা তাদের মানসিক চাপে ফেলে এবং একাডেমিক ফলাফলে বিরূপ প্রভাব ফেলে।
সিলেট অঞ্চলের কয়েকটি বিদ্যালয়ের অভিভাবকদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট পর্যবেক্ষণ করে আমি একাধিকবার এসব বিষয় উপলব্ধি করেছি। যেমন, সরকারি অগ্রগামী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ব্লু বার্ড হাই স্কুল ও কলেজ কিংবা জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্ট পাব্লিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধিকাংশ অভিভাবকই শিক্ষা ও আর্থিক দিক দিয়ে সমৃদ্ধ। ফলে এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পাশাপাশি শৃঙ্খলা ও আচরণগত দিক থেকেও তুলনামূলকভাবে উৎকর্ষ অর্জন করে। অন্যদিকে কতিপয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে যাদের অধিকাংশ অভিভাবকেরা তুলনামূলকভাবে শিক্ষা ও আর্থিকভাবে সীমিত। এর প্রতিফলন শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ও আচরণগত মান কিছুটা হলেও দৃশ্যমান।
এছাড়া আমার বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের একটি প্রশ্ন করি—তারা নিয়মিত সুষম খাবার গ্রহণ করে কি না, শাকসবজি খেতে পছন্দ করে কি না এবং দিনে পর্যাপ্ত পানি পান করে কতজন। তাদের উত্তর ও আচরণ বিশ্লেষণ করে লক্ষ্য করি, যেসব শিক্ষার্থীর পরিবার শিক্ষিত ও আর্থিকভাবে স্বচ্ছল, তারা খাদ্য ও পুষ্টির বিষয়ে অধিক সচেতন। তাদের পরিবার নিয়মিতভাবে শাকসবজি খাওয়ায়, পানি পানের গুরুত্ব বোঝায় এবং সুষম খাবার নিশ্চিত করতে চেষ্টা করে। ফলে অভিভাবকের শিক্ষা ও আর্থিক সক্ষমতা কেবল শিক্ষায় নয়, বরং স্বাস্থ্য ও জীবনযাপনের মানেও গভীর প্রভাব ফেলে।
তবে বাস্তবতা এমনও যে, কিছু শিক্ষিত ও স্বচ্ছল অভিভাবক অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের কারণে শিক্ষকদের পরামর্শকে গুরুত্ব দেন না। তারা নিজেদের অবস্থান ও অভিজ্ঞতাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে বিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত ও শিক্ষকদের মতামত নিয়ে অহেতুক সমালোচনায় লিপ্ত হন। এতে শিক্ষক-অভিভাবক সম্পর্কে ফাটল ধরে এবং শিক্ষার্থীর উপরও বিরূপ প্রভাব পড়ে। এই মানসিকতা শিক্ষার পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং পরোক্ষভাবে শিক্ষার্থীর একাডেমিক উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
এই প্রেক্ষাপটে বিদ্যালয়ের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যালয়কে অভিভাবকদের সচেতন করতে হবে, নিয়মিত অভিভাবক সমাবেশ আয়োজন করতে হবে এবং সন্তান লালন-পালনে কীভাবে একটি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা যায় সে বিষয়ে নির্দেশনা দিতে হবে। একই সঙ্গে সমাজের অন্যান্য অংশ—স্থানীয় প্রশাসন, গণমাধ্যম, এনজিও ও সচেতন নাগরিকদেরও এগিয়ে আসতে হবে।
সবশেষে বলতেই হয়, একজন শিক্ষার্থীর একাডেমিক উন্নতি নির্ভর করে কেবল তার মেধার উপর নয়, বরং তার পরিবার কতটা সচেতন, শিক্ষিত ও সহানুভূতিশীল, তার উপরও। অভিভাবক যদি সন্তানের পাশে থাকেন, তাকে ভালোবাসার পাশাপাশি দিকনির্দেশনা দেন, তাহলে শিক্ষার্থী নিজেকে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী, সুরক্ষিত ও উদ্যমী মনে করে। শিক্ষকের সঙ্গে সম্মানজনক সম্পর্ক বজায় রেখে, বিদ্যালয়ের পরামর্শ অনুসরণ করে অভিভাবক যদি সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসেন, তাহলে একটি শিক্ষাবান্ধব সমাজ গঠন সম্ভব। আর তাতেই গড়ে উঠবে গুণগত ও মানবিক শিক্ষা।