উপেক্ষিত মানসিক স্বাস্থ্য
প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ এপ্রিল ২০২১, ৮:৪১:১৬ অপরাহ্ন
করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাবের পর থেকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রায় এসেছে অনেক পরিবর্তন। ব্যক্তি থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনে পড়েছে মহামারির বিরূপ প্রভাব। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের একটি বাড়িতে ৬ বাংলাদেশীর লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। পুলিশ বলছে বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া দুই ভাই তাদের বাবা, মা, বোন ও নানীকে হত্যার পর নিজেরাও আত্মহত্যা করেছে।
জানা গেছে, এই দুই ভাই ডিপ্রেশন বা বিষন্নতায় আক্রান্ত ছিলো বলে ঘটনার আগে লেখা ফেসবুক নোটে উল্লেখ করেছে। দুই ভাইয়ের মধ্যে ছোট ছেলে ছেলে ফেসবুক নোটে তাদের বিষন্নতায় ভোগার ইতিহাস হত্যার পরিকল্পনা ও ঘটনা সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছে।
অপরদিকে বাংলাদেশের মৌলভীবাজারের একটি গ্রামে সম্প্রতি এক কিশোরী নিজ ঘরের তীরের সাথে গলার রশি পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছে। পুলিশ জানায়, কিশোরী দীর্ঘদিন যাবৎ মানসিক সমস্যায় ভুগছিলো। উপরের এই দুই ঘটনার প্রেক্ষাপট, পটভূমি ও পরিবেশ ভিন্ন হলেও সমস্যা এক ও অভিন্ন। বিশ্বে করোনা মহামারি মানুষের অর্থনৈতিক জীবনে বিপর্যয় নিয়ে এসেছে একথা সত্য। তবে এর পাশাপাশি মানুষের মনোজগতেও এই মহামারি তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, এতে কোন সন্দেহ নেই। বাংলাদেশে করোনার সময়ে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবার সুযোগ নেই।
এ ব্যাপারে চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকরাও প্রায় নীরব। শারীরিক অসুস্থতা নিয়েই তাদের রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। তবে কথায় আছে, ‘অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?’ চোখ বুজে থাকলেও কিংবা গুরুত্ব না দিলেও করোনা পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়ায় এদেশে যে একটি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দিনদিন প্রকট হয়ে ওঠছে, এ নিয়ে এখনি চিন্তাভাবনা প্রয়োজন। প্রয়োজন করোনা সংকটকালে মানসিক স্বাস্থ্যরক্ষা ও মানসিক অসুস্থতার সুষ্ঠু চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। করোনার মারাত্মক বিস্তার ও অসুস্থতার মধ্যে দেশে বিভিন্ন অপরাধ হ্রাস পেতে দেখা যাচ্ছে না, বরং অনেক ক্ষেত্রে বৃদ্ধি পেয়েছে। করোনা মহামারি শুরুর পর গত এক বছরে এদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন এবং ধর্ষণের ভয়াবহ বিস্তার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত এক বছরে মারামারি ও খুনোখুনির ঘটনাও কম ঘটেনি। কম ঘটেনি আত্মহত্যার ঘটনা। এটা মানুষের সামাজিক ও ব্যক্তি জীবনের এক বিশৃঙ্খল অবস্থার বহিঃপ্রকাশ।
এছাড়া ইতোমধ্যে দেশে নানা ইস্যু নিয়ে প্রায়ই লোকজনকে উত্তেজিত হয়ে ওঠতে দেখা যাচ্ছে। যে ক্ষেত্রে ধৈর্য্য ও সহনশীলতা এবং দুরদর্শিতা প্রয়োজন, সেক্ষেত্রে আকস্মিক উত্তেজনা ও অদূরদর্শী কর্মকান্ড প্রবল হয়ে ওঠতে দেখা যাচ্ছে। আর সরকারকেও জনগণের আর্থিক সামাজিক ও মানসিক অবস্থা আমলে না নিয়ে গতানুগতিক পন্থায় তা মোকাবেলার চেষ্টা করতে দেখা যাচ্ছে। এতে সংকট আরো ঘনীভূত হচ্ছে। সমাজ ও রাষ্ট্রে অস্থিরতা আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দেখা যাচ্ছে, সরকারের কিছু অদূরদর্শী পদক্ষেপের ফলে জনগণের মাঝে ক্ষোভ ও অসন্তোষ বাড়ছে। যেমন আকস্মিক ও অসময়ে দেয়া লকডাউন। মানুষের খাদ্যাভাব ও আর্থিক সংকটের সুরাহা না করে মানুষকে দোকানপাট বন্ধ রেখে ঘরে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এটা অযৌক্তিক ও অমানবিক। এতে সংশ্লিষ্ট লোকজনের মাঝে ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি করেছে। এতেও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রতিক্রিয়া বা খারাপ প্রভাব পড়ছে। এটা জাতির ভবিষ্যতকে অন্ধকারের দিকে পরিচালিত করছে। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতে, কঠোর পরিশ্রম মানুষের শরীরের ওপর যতোটা চাপ সৃষ্টি করে তার চেয়েও বেশী ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে মানসিক চাপ অর্থাৎ দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনা। তাই বর্তমান সংকটের সময় দেশের জনগণের শারীরিক স্বাস্থ্যরক্ষার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি উপেক্ষিত হওয়া উচিত নয়। মানসিক স্বাস্থ্য উপেক্ষিত হলে পরিবার ও সমাজে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে।
এ ব্যাপারে দেশের স্বাস্থ্য বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সচেতনতা ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরী বলে আমরা মনে করি। বর্তমান মহামারির নাজুক পরিস্থিতিতে জনগণের মাঝে উত্তেজনা ও বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয়, এবং এমন পদক্ষেপ গ্রহণ থেকে সরকারের বিরত থাকা উচিত। অর্থনৈতিক সংকট দূরীকরণের নানা কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে মানুষের মন থেকে হতাশা দূর করতে হবে। আর স্বাস্থ্য বিভাগকে শারীরিক অসুস্থতার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে হবে। বর্তমানে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অন্যান্য ইস্যুকে কেন্দ্র করে প্রায়ই দেশে অস্থিরতা ও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকার বিশেষভাবে ক্ষমতাসীন দল বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে হবে। অন্ততঃ এই মহামারির দুঃসময়ে বিরত থাকতে হবে সবধরনের উত্তেজনা ও অস্থিরতা সৃষ্টিকারী কর্মকান্ড থেকে। একটি হতাশা ও বিষন্নতামুক্ত জাতির স্বার্থে এ মুহূর্তে এসব দায়িত্ব পালন ও মূল্যবোধের অনুশীলন একান্ত আবশ্যক বলে আমরা মনে করি।