সংযমের মাসে চরমপন্থা কেনো?
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ এপ্রিল ২০২১, ৭:৩৫:২৫ অপরাহ্ন
গতকাল চট্টগ্রামের বাঁশখালিতে একটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে বেতন-ভাতা বাড়ানো দাবিতে আন্দোলনকারী শ্রমিকদের ওপর পুলিশের গুলি বর্ষণের ঘটনায় কমপক্ষে ৫ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন বহুলোক। বিশেষভাবে এই সংযমের মাস রমজানে এমন ঘটনা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। বিশ্বের যেকোন দেশেই শ্রমিক শ্রেণী তাদের বেতন-ভাতা কিংবা অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বাড়ানোর দাবি জানাতে পারে। প্রয়োজনে এজন্য আন্দোলন, কর্মবিরতি বা ধর্মঘট করতে পারে। এটা তাদের গণতান্ত্রিক এমনকি আইনানুগ অধিকার। কিন্তু আন্দোলনকারী শ্রমিকদের গুলি করে হতাহত করার ঘটনা যেমন অস্বাভাবিক, তেমনি অমানবিক। কিন্তু বাংলাদেশে যে কোন বিক্ষোভ-আন্দোলন দমনে গুলি করে মানুষ হত্যা যেনো ইদানিং ডালভাতের মতো সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মাঝে মাঝে ক্ষোভ-বিক্ষোভ ও আন্দোলনের ঘটনা ঘটে। এ সময় পুলিশের সাথে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। কিন্তু এসবক্ষেত্রে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের দমনে চরম ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দেয়। কারণ পুলিশ হচ্ছে অস্ত্রধারী ও ক্ষমতাশালী, অপরদিকে বিক্ষোভকারীরা নিরস্ত্র ও ক্ষমতার বাইরের লোক। তাই পুলিশ বা সশস্ত্র বাহিনীকে এসব ক্ষেত্রে ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দিতে হয়। এটাই আইনসম্মত ও মানবিক। কিন্তু বাংলাদেশে যে কোন বিক্ষোভ দমনে সেটা রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক অথবা শ্রমিকদের হোক, সকল বিক্ষোভের ক্ষেত্রেই পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রায়ই চরমপন্থা অবলম্বন করতে দেখা যাচ্ছে। বেশ কয়েক বছর আগে চট্টগ্রামের একই প্রতিষ্ঠান নিয়ে বিক্ষোভ আন্দোলন হয়। তখনো পুলিশ একই কায়দায় গুলি করে অনেক লোককে হতাহত করেছিলো। পরে বিপুল ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছিলো নিহতদের পরিবারকে। প্রশ্ন হচ্ছে, কথায় কথায় গুলি করে মানুষ হত্যা করে কিছু পরিবারকে কেনো অসহায়ত্বের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে? আর পরে ক্ষতিপূরণ দিয়ে সেটা মীমাংসার চেষ্টা করা হচ্ছে? এতে লাভ হচ্ছে কার? এতে কি আসলেই সমস্যার কোন সমাধান হচ্ছে না-কি সমস্যা আরো জটিল আকার ধারণ করছে?
বর্তমান সময়ে বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই শ্রমিক কিংবা অন্যান্য অসন্তোষ নিরসনে আলোচনার পন্থা অবলম্বন করতে দেখা যায় সরকারকে। কিন্তু বাংলাদেশে এর ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অনেকক্ষেত্রেই বিক্ষোভ ও অসন্তোষ দমনের ক্ষমতা বা দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে পুলিশকে। পুলিশ অস্ত্রের বলে চেষ্টা করছে সমস্যা সমাধানের। বিষয়টি যেমন অগণতান্ত্রিক তেমনি মানবাধিকারের পরিপন্থী। আর এই গণতন্ত্রহীন ও অমানবিকতার চর্চা বা অনুশীলন হচ্ছে এখন গোটা দেশেই। ক্ষমতার উচ্চপর্যায় থেকে নিম্নপর্যায় পর্যন্ত। ফলে প্রায়ই উত্তেজনা সৃষ্টি হচ্ছে। এতে প্রাণহানি হচ্ছে। পঙ্গু হচ্ছেন অনেকে। বিপুল সরকারী ও বেসরকারী সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে। কিছুদিন আগে এ ধরণের গোলাগুলি ও উত্তেজনা সৃষ্টির ঘটনায় প্রাণহানি ছাড়াও দেশের বিপুল সম্পদ নষ্ট হয়েছে। এভাবে সম্পদহানি বাংলাদেশের মতো একটি দরিদ্র দেশের জন্য যে কী পরিমাণ ক্ষতিকর তা বুঝার ক্ষমতা যেনো সরকার কিংবা বিক্ষোভকারী কারোর নেই।
উন্নত দেশগুলোর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা সংস্থাগুলো যে কোন বিক্ষোভ দমনে একবারেই থার্ড ডিগ্রি মেজারমেন্টে চলে যায় না। তারা প্রথমে খালি হাতে বিক্ষোভ দমনের চেষ্টা করে। পরে করে লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ। সবশেষে পরিস্থিতি যখন কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসে না তখন হয় একদম নিরব হয়ে যায় কিছু সময়ের জন্য কিংবা সীমিত পর্যায়ে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে। এতেই কাজ হয়ে যায়। কিন্তু বাংলাদেশে বিরোধী দল একটি মিছিল বের করলেই শুরু হয় গুলিবর্ষণ। এর মারাত্মক কুফল রয়েছে। আজ ক্ষমতায় থেকে যে দল এটা করছে, আগামীতে বিরোধী দলে গেলে এবং বিরোধী দল ক্ষমতায় গেলে ঠিক একই ধরনের প্রতিশোধের ঘটনা ঘটতে পারে। এতে দেশে অসন্তোষ, উত্তেজনা এমনকি গৃহযুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে। ব্যাঘাত ঘটতে পারে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে।
আমরা লক্ষ্য করছি এদেশে সরকারের অগণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা ও জবাবদিহিতাহীন পদক্ষেপ দিনদিন শুধুই বাড়ছে। আর এসবের পেছনে খোঁজা হচ্ছে বিরোধী রাজনৈতিক দলের ইন্ধন বা চক্রান্ত তথা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরকারের পুলিশের ওপর তথা অস্ত্রের ওপর নির্ভরশীলতাই বিশেষভাবে দায়ী। আমরা সকল সমস্যা, তা বেতনভাতা বৃদ্ধি বা অন্যান্য দাবিদাওয়া নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভ বা আন্দোলনই হোক, তা নিরসনে আলোচনার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পন্থায় সমাধানের আহ্বান জানাচ্ছি। ক্ষমতাসীনদের বলপ্রয়োগের পন্থা বা মানসিকতা থেকে সরে আসার অনুরোধ জানাচ্ছি। কারণ হত্যা হত্যাই ডেকে আনে। অসন্তোষ ও উত্তেজনা জন্ম দেয় অধিকতর অসন্তোষ ও উত্তেজনার। সর্বোপরি প্রতিটি ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে। আশা করি, বুদ্ধিমানদের তা অনুধাবনে কষ্ট হবে না। কারণ, ‘আকলমন্দকে নিয়ে ইশারাই কাফি’।