রক্ষকই যখন ভক্ষক!
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ এপ্রিল ২০২১, ৯:৫১:৩৭ অপরাহ্ন
করোনা মহামারির দরুন গত এক বছরে বাংলাদেশে কোটি মানুষ যখন দরিদ্র হয়ে পড়েছেন, তখন কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহামারির মধ্যেও দেশের বিত্তশালীদের আয় কমেনি ফলে নানা সংকটের মধ্যেও দেশে বাড়ছে কোটিপতি আমানতকারীর হিসাব। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে এক কোটি টাকার বেশী আমানত রয়েছে এমন অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ৯৩ হাজার ৮৯০টি।
ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতকারী হিসাবের সংখ্যা ছিলো ১১ কোটি ৫৮ লাখ ১২ হাজার ৯৬৬টি। এর মধ্যে কোটি টাকার উপরে রয়েছে এমন হিসাবের সংখ্যা ছিলো ৯৩ হাজার ৮৯০টি। মাত্র ৩ মাসের ব্যবধানে কোটিপতিদের হিসাবের সংখ্যা বেড়েছে ৬ হাজার ৪০০টি। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে কোটিপতি হিসাব ছিলো ৮৩ হাজার ৮৩৯টি। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে কোটিপতি আমানতকারী হিসাব বেড়েছে ১০ হাজার ৫১টি।
১৭ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ যখন প্রাত্যহিক জীবনের ব্যয় নির্বাহে হিমশিম খাচ্ছে, তখন দেশে কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধি, তা-ও অস্বাভাবিক হারে এবং করোনাকালীন অস্বাভাবিক সময়ে, দেশের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার ইংগিত প্রদান করে। এটা দেশের অর্থনীতিতে সম্পদ বন্টনে চরম বৈষম্যের বহিঃপ্রকাশ। কোন কল্যাণধর্মী রাষ্ট্রে এমন অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা সচরাচর দেখা যায় না। বিশ্বের পুঁজিবাদী দেশগুলোতে বিত্তবানদের সংখ্যা ও সম্পদ বেশী। এটা পুঁজিবাদের নেতিবাচক দিক। কিন্তু সে সব দেশে সাধারণ মানুষের খেয়ে পরে সুখেশান্তিতে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা আছে। এসব দেশের সরকার অন্ততঃ দেশের মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বের সবচেয়ে বেশী সংখ্যক বিলিওনার তথা অতিধনী মানুষের বাস। দিন দিন তাদের সম্পদের পরিমাণ বাড়ছে। তবে এর পাশাপাশি সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নে সে দেশের সরকার বসে নেই। বিভিন্ন সময়ে সর্বনি¤œ মজুরীর হার বাড়িয়ে, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করে এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে সরকার দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ ইউরোপীয় দেশগুলোও একই পন্থা অবলম্বন করছে। কিন্তু এক্ষেত্রে বাংলাদেশের চিত্র ভিন্ন। বাংলাদেশে বিত্তবানদের সম্পদ বাড়লেও সাধারণ সীমিত ও স্বল্প আয়ের মানুষের আর্থিক অবস্থার ক্রমশঃ অবনতি ঘটছে। সাম্প্রতিক এক জরিপে প্রায় দেড় কোটি মানুষের দারিদ্র্য সীমার নীচে নেমে যাওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। এটা দেশের অর্থনীতির জন্য এক চরম অশনি সংকেত। অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচায়ক।
সবচেয়ে গুরুতর ব্যাপার হচ্ছে, একশ্রেণীর মানুষ বিশেষভাবে ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাসীনদের ঘনিষ্ট লোকজন অর্থবিত্তে ফুলে ফেঁপে ওঠছে। গত কয়েক বছরে তাদের সম্পদ বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। দেখা গেছে, তাদের অনেকেই বিপুল অর্থ বিদেশী ব্যাংকে পাচার করেছেন কিংবা বিদেশে বিনিয়োগ করেছেন। দেশের বিত্তবানদের অ্যাকাউন্টের হিসাবের বাইরে তাদের সম্পদ ও অ্যাকাউন্ট। তাদের সম্পদ ও অ্যাকাউন্ট যোগ হলে এদেশে ধনী ও সুবিধভোগী মানুষের সংখ্যা যে আরো অনেক বৃদ্ধি পাবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। বাইরে অর্থ পাচারকারী এসব বিত্তবানকে অধিকাংশই দুর্নীতির সাথে জড়িত। অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ দেশে রাখা নিরাপদ নয়, তাই তারা শতশত এমনকি হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে এবং এখনো করছে। কিছুদিন আগে বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বিভিন্ন মহল থেকে দাবি জানানো হয়। কিন্তু এক্ষেত্রেও সরকারের কোন ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া বা পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়নি।
এই করোনা মাহামারির সময়ে স্বাস্থ্যখাতে হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। কিন্তু এসব অর্থের বেশীর ভাগই লুটপাট ও আত্মসাত করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে করোনা নিয়ন্ত্রণ শিকেয় ওঠেছে। এখনো দেশের ৯০ ভাগ মানুষ ভ্যাকসিনেশনের বাইরে। টিকা আমদানির বিষয়টি চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। করোনার থাবা প্রসারিত হচ্ছে, মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। কিন্তু করোনা নিয়ন্ত্রণে কোন সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নেই। নেই চিকিৎসার নিশ্চয়তা।
বিশেষজ্ঞদের মতে দেশের দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষের ওপর কী প্রভাব ফেলছে বা ফেলবে, তা অনুভূত হতে আরো কিছুদিন লাগবে। এই প্রণোদনা ও সহায়তাহীন অপরিকল্পিত লকডাউনে যে লাখ লাখ মানুষের ঋণের বোঝা আরো বাড়িয়ে দেবে, শেষ সঞ্চয়টুকুও কেড়ে নেবে, এমন আশংকা অর্থনীতিবিদদের।
সর্বোপরি, এই করোনাকালীন সময়েও দুর্নীতি থেমে থেমে নেই। থেমে নেই সুবিধাভোগীদের অর্থসম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি। অপরদিকে দরিদ্র মানুষ আরো দরিদ্র হচ্ছে। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে তাদের দিশেহারা অবস্থা। এ অবস্থার অবসান প্রয়োজন। কিন্তু কে করবে তা? রক্ষকই যে ভক্ষকের ভূমিকায়।