যৌতুকের জন্য নিমর্মতা
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ এপ্রিল ২০২১, ৭:২৯:১৩ অপরাহ্ন
রোববার বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ‘গৃহবধূকে ন্যাড়া করে স্বামী-সতীনের নির্যাতন’ এবং ‘বিয়ের আসরে কনে পক্ষের উপহার নিয়ে মারামারি’ শীর্ষক দু’টি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম ঘটনাটি ঘটেছে সিলেটের দক্ষিণ সুরমা লালাবাজার ইউনিয়নের শাহ সিকান্দর গ্রামে। এখানে যৌতুকের দায়ে স্বামী, সতীন ও ননদের অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন জনৈক গৃহবধু। গৃহবধূ দু’টি অবুঝ সন্তানের সামনে অসহায়ভাবে নির্যাতনের শিকার হন যৌতুকের জন্য। পেছনে তার হাত বেঁধে গোপন অঙ্গসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়। পৈশাচিক কায়দায় ন্যাড়া করে মাথায় ঢেলে দেয়া হয় গরম আলকাতরা। পরে খবর পেয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের লোকজন স্বামীর গৃহ থেকে উক্ত গৃহবধূকে শিকল বাঁধা অবস্থায় উদ্ধার করেন।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ২০১৩ সালে উক্ত গৃহবধূর সাথে দক্ষিণ সুরমার শাহ সিকান্দর গ্রামের মৃত মনির আলীর ছেলে শাহিন মিয়ার বিয়ে হয়। বেশ কিছুদিন যাবৎ যৌতুকের জন্য স্বামী শাহিন মিয়া উক্ত গৃহবধূকে নির্মম নির্যাতন করছিলো। কয়েক দিন আগে শাহিন মিয়া তার স্ত্রীর মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করলে তার মাথা ফেটে যায়। মাথায় চারটি সেলাই দিতে হয়। এরপর স্বামীর নির্যাতন সইতে না পেরে এবং দুই সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে গৃহবধূ তার পিতার নিকট থেকে ২০ হাজার টাকা এনে স্বামীর হাতে তুলে দেন। কিছু দিন পর স্বামী শাহিন মিয়া সাবিনা বেগম (২৫) নামে আরেকটি মেয়েকে বিয়ে করেন। দ্বিতীয় বিয়ের পর শাহিন মধ্যপ্রাচ্যে চলে যান। কিন্তু কিছু দিন পর আবার দেশে ফিরে অসেন। দেশে এসে শাহিন প্রাইভেট কার চালাতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে আবারো গৃহবধূকে চাপ দেন তার পিতার নিকট থেকে ৫০ হাজার টাকা এনে দেয়ার জন্য। অভাবগ্রস্ত পিতার কাছে টাকা চাইতে পারবে না বলে জানালে শাহিন স্ত্রীকে দেহ ব্যবসার কথা বলেন। দেহ ব্যবসার কু-প্রস্তাবে রাজী না হলে তার ওপর শুরু হয় স্বামী ও সতীনের অমানুষিক নির্যাতন। তার শরীরে বৈদ্যুতিক শক দেয়ার পর স্বামী ও সতীন মিলে ব্লেড দিয়ে তার মাথা ন্যাড়া করে ঘর থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে মাথায় গরম আলকাতরা ঢেলে দেয়। গলায় জুতোর মালা পরিয়ে শিকল দিয়ে বারান্দায় বেঁধে রাখা হয় তাকে।
উপরের ঘটনাটি যৌতুকের জন্য নারী নির্যাতনের একটু নিষ্ঠুরতম ঘটনা। তবে যৌতুক বিরোধী আইন প্রণয়নের পর থেকে এবং মানুষের মাঝে যৌতুকের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে ওঠার প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ সুরমায় সংঘটিত যৌতুকের জন্য এই নির্যাতনের ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে অস্বাভাবিক ও নজিরবিহীন। তবে একথা সত্য যে, যৌতুকের জন্য এ ধরণের দৈহিক নির্যাতন ইদানিং কিছুটা কমে এলেও ভিন্ন আঙ্গিকে এটা সমাজে বিদ্যমান। যৌতুকের জন্য স্বামী কিংবা স্বামীর বাড়ির লোকজনের পক্ষ থেকে স্ত্রী ও তার পিতামাতা ও ভাইয়ের ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টির ঘটনা অহরহ ঘটছে। অনেক সময় স্বামীর বিদেশ যাওয়ার জন্য কিংবা দেশে ব্যবসার জন্য টাকা দাবী করা হচ্ছে যৌতুক হিসেবে। বিয়ের সময় উপহারের নামে দাবি করা হচ্ছে যৌতুক। এর ফলে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য ও অশান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা পর্যন্ত ঘটছে। খবর নিলে দেখা যাবে, বর্তমানে সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনাগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই যৌতুকের কারণে ঘটছে। নারী ও শিশু নির্যাতন সংক্রান্ত আদালতে এ ধরণের অসংখ্য মামলা এখন বিচারাধীন বলে জানা গেছে।
দেখা গেছে, অনেক সচ্ছল পরিবার মেয়ের বিয়েতে বিস্তর দামী জিনিসপত্র এমনকি নগদ অর্থও প্রদান করেন। এভাবে বিয়েতে এসব প্রদানের বিষয়টি অনেকটা প্রথা বা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। এসব প্রকারান্তরে অসচ্ছল পরিবারগুলোতে যৌতুক দাবি ও আদায়ে উৎসাহিত করছে। এ ধরণের আরো কিছু ক্ষতিকর সামাজিক প্রথা বিদ্যমান। যেমন স্ত্রীর পিতামাতা, ভাই কর্তৃক রমজানে বিপুল অর্থ ব্যয়ে স্বামীর বাড়িতে ইফতারি প্রদান। এগুলোও সমাজের ঘৃন্য ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ যৌতুক প্রথার পেছনে ইন্ধন যোগাচ্ছে। সকল সচেতন ও বিবেকবান মানুষ এই জঘন্য প্রথা ও রেওয়াজ বর্জন করার আহবান জানিয়ে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। এতে অবশ্য ফলও হয়েছে। বর্তমান সময়ে কিছুটা হলেও এসব হ্রাস পেয়েছে। পত্র-পত্রিকা ও সামাজিক আহবানের ফলে অনেকের মাঝে এ ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। কোন সভ্য সমাজে যৌতুক দাবি কিংবা যৌতুকের জন্য নারী নির্যাতন গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমরা উপরে উল্লেখিত যৌতুকের জন্য নির্যাতনের সাথে জড়িতের উপযুক্ত আইনানুগ শাস্তি দাবি করছি এবং এ ধরণের ঘটনা প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা ও জনমত গড়ে তোলার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।