চাল নিয়ে চালবাজি অব্যাহত
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:১৮:৪৫ অপরাহ্ন
সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আমন ধানের বাম্পার ফলনে কৃষকের মুখে হাসির খবর প্রকাশিত হচ্ছে বিভিন্ন মিডিয়ায়। কিন্তু এর পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে ফের চালের দাম বাড়ার দুঃসংবাদও। গতকাল একটি স্থানীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, সিলেটের কানাইঘাটে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ জুড়ে এখন শোভা পাচ্ছে আমনের সোনালী ধান। অপরদিকে অন্য একটি সংবাদে বলা হয়েছে, বাজারে ফের উত্তাপ ছড়াচ্ছে চালের দাম। সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে মোটা চালসহ প্রায় সবধরণের চালের দাম। মোটা চাল প্রতি কেজিতে ন্যুনতম বেড়েছে ২ টাকা। আর মাঝারি চালের দাম বেড়েছে ২-৫ টাকা। চাল বিক্রেতাদের বক্তব্য হচ্ছে, সব চালেই পাইকারি ক্রয়ে দাম বেড়েছে। চালের মান অনুযায়ী কেজি প্রতি দাম বেড়েছে ৫ টাকা পর্যন্ত। তবে তাদের দাবি কিছুদিনের মধ্যে বাজারে আমনের নতুন চাল আসবে। তখন আবারও দাম কমতে পারে। বাজারে দোকানিদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বাজারে মোটা পাইজাম চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৬-৬০ টাকা। মাঝারি মানের চাল ৭০-৭২ টাকা এবং সরু নাজিরশাইল ৭৫-৮৫ টাকা।
সম্প্রতি সচিবদের এক বৈঠকে বলা হয়, সরকারী গুদামে ১৬ লাখ টনের বেশি চাল ও গমের মজুত আছে। তারপর মিল মালিক ও বড় ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে চালের দাম বাড়ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সচিব যখন জানেন ও স্বীকার করছেন যে, একটি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর কারসাজিতে চালের দাম বাড়ছে, তখন এদের কারসাজি প্রতিরোধে সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছেন বা নিচ্ছেন? অতীতের দিকে তাকালে দেখা যায়, মৌসুম আসার সাথে সাথেই কমে যেতো ধান চালের দাম। বাজারে ধান ওঠার আগেই পাইকারী ব্যবসায়ীরা তাদের মজুত থেকে ধান চাল বাজারে ছাড়তেন নতুন ধান-চাল ওঠানোর জন্য। এ সময় বাজারে ধান চালের সরবরাহ পর্যাপ্ত হওয়ায় দাম পড়ে যাওয়ার ভয়ে তারা আগের মজুতকৃত ধান চাল বিক্রয় করে দিতেন। কিন্তু গত ক’বছর ধরে ভর মৌসুমেও ধান চালের দাম কমতে দেখা যাচ্ছে না। উল্টো বিস্ময়করভাবে বাড়তে দেখা যাচ্ছে। এবারও চালের বাজারে এটা লক্ষণীয়। ইতোমধ্যে মৌসুম আসা সত্বেও বাজারে চালের দাম উর্ধমুখী। আশংকা করা হচ্ছে, নতুন ধান-চাল বাজারে এলেও চালের দাম হয়তো কমবে না, গত কয়েক বছর ধরে যেভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
একথা এখন অনেকের কাছেই স্পষ্ট যে, ধান-চালের মজুত কিংবা এগুলোর মূল্য নির্ধারনের বিষয়টি এখন আর পাইকারী কিংবা খুচরো ব্যবসায়ীদের হাতে নেই। অতীতে মজুতদারি নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। কিছু অসাধু পাইকারী ব্যবসায়ীকে ধান চাল মজুত করে ঘাটতি মৌসুমে বাড়তি মুনাফা লুটতে দেখা গেছে। কিন্তু এখন ধান চালের ব্যবসাকে সম্পূর্ণ কুক্ষীগত করে নিয়েছে একটি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট, যারা মিলার ও বড় বড় ব্যবসায়ী। ক্ষমতাসীন মহল তথা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এই সিন্ডিকেট দেশের বাজারে ধান চালের সরবরাহ ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের বেঁধে দেয়া দামে দেশের পাইকারী ও খুচরো ব্যবসায়ীরা চাল বিক্রয়ে বাধ্য হচ্ছে। ফলে ভর মৌসুমেও কমছে না চালের দাম। ফলে দেশজুড়ে সাধারণ সীমিত আয়ের মানুষের জীবনে চরম দুর্ভোগ নেমে এসেছে।
এভাবে ধান চাল নিয়ে কারসাজির পাশাপাশি চাল আমদানি নিয়েও চলছে তেলেসমাতি। এখানে কাজ করছে একই সিন্ডিকেট। ধান চালের পর্যাপ্ত মজুত সত্বেও সরকারীভাবে চাল আমদানি করা হচ্ছে। তা-ও প্রতিযোগিতামূলক বাজার থেকে না কিনে স্বার্থের ভাগাভাগিতে কোন নির্দিষ্ট দেশ থেকে। এ ব্যাপারে দেশের উপরোক্ত শীর্ষ দৈনিকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি ভিয়েতনাম যে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের সফরের ব্যয় বহন করছে, তার পেছনেও গূঢ় রহস্য আছে। বাংলাদেশ ভিয়েতনাম থেকে ২ লাখ ৩০ হাজার টন চাল কেনার চুক্তি করেছে, যার মধ্যে সেদ্ধ চালের দাম প্রতি টন ৫২১ ডলার ও আতপ ৪৯৪ ডলার। অথচ প্রতিবেশী থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, মিয়ানমার, ভারত ও পাকিস্তান থেকে অনেক কম দামে এই চাল কেনা যেতো। উল্লেখিত দেশগুলোতে যেখানে চালের দাম টন প্রতি ৪০০ ডলারের সামান্য বেশীয় বা কম, সেখানে প্রায় ১০০ ডলার বেশী দিয়ে ভিয়েতনাম থেকে চাল কেনার কী যুক্তি থাকতে পারে-এমন প্রশ্ন সংশ্লিষ্ট মহলের।
এভাবে চাল নিয়ে দেশের শীর্ষ মহলসহ একটি অসাধু সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে কারসাজি চালিয়ে যাচ্ছে। এর যাঁতাকলে পড়ে এদেশের কোটি কোটি মানুষকে নিদারুন দুঃখকষ্টের মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে। তাদের আয়ের একটি বড় অংশ চলে যাচ্ছে চাল কিনতে। যাদের কারসাজিতে এই ভর মৌসুমেও ধান চালের দাম বাড়ছে এবং এই প্রধান খাদ্যপণ্য ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে কার্যত: কোন ব্যবস্থাই নিতে দেখা যাচ্ছে না সরকারকে। এতে চরম বিস্মিত ও হতাশ সাধারণ মানুষ।