গ্যাস সংকটে স্থবির শিল্প খাত
প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:১১:৩৮ অপরাহ্ন
সম্প্রতি মিডিয়ায় ‘গ্যাস সংকটে নাকাল শিল্প’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, গ্যাস সংকটের কারণে প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে দেশের শিল্প কারখানার উৎপাদন। চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল সরবরাহের কারণে রেশনিং পদ্ধতিতে বন্টন করতে হচ্ছে গ্যাস। অন্যদিকে বিশ্ববাজারে এলএনজি’র মূল্যবৃদ্ধি ও ডলার সংকটের কারণে পর্যাপ্ত পরিমাণ গ্যাস আমদানি করাও সম্ভব হচ্ছে না। এমন সংকটময় মুহূর্তেও দেশে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে যথাযথ কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না। জ্বালানী বিশেষজ্ঞদের মতে, আপৎকালীন বিভিন্ন পদক্ষেপের পাশাপাশি সরকারকে জ্বালানী সংকট মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিতে হবে। বৈশ্বিক জ্বালানী পরিস্থিতির উন্নতি না হলে নিজেদের রিসোর্স থেকে জ্বালানী সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য নতুন গ্যাস ক্ষেত্র অনুসন্ধানের কোন বিকল্প নেই। সরকারের এমন কোন ‘বিশেষ উদ্যোগ’ দৃশ্যমান না হওয়া হতাশাব্যঞ্জক।
তারা আরো বলেছেন, গ্যাসের অনুসন্ধান বাড়ানো না হলে আগামীতে দেশ আমদানি করা এলএনজির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। যা অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। এলএনজি আমদানি করতে প্রতি বছর বিশাল অংকের টাকা ব্যয় হচ্ছে। চলতি অর্থ বছরে বাজেটে এলএনজি খাতে ভর্তুকির জন্য প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে প্রকাশ, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত গ্যাস ফিল্ডের সংখ্যা ২৮টি। এসব গ্যাস ফিল্ডের মজুত ৩৫ দশমিক ৮০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) গ্যাস। এর মধ্যে উত্তোলনযোগ্য রয়েছে ২৮ দশমিক ৪৭ টিসিএফ। ইতোমধ্যে ১৮টি টিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। চাহিদা মাফিক দেশে প্রতি বছর ১ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হয়।
হিসাব অনুযায়ী, দেশে আর মাত্র ১০ বছর চলার মতো গ্যাসের মজুত আছে। নতুন করে গ্যাস আবিস্কার ও উত্তোলন সম্ভব না হলে ১০ বছর পর সব গ্যাস ফুরিয়ে যাবে। পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা সাড়ে ৩ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে দেশীয় গ্যাস ক্ষেত্রগুলো থেকে উৎপাদিত হচ্ছে ২৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। চুক্তির ভিত্তিতে কাতার ও ওমান থেকে আসছে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট। চাহিদার বিপরীতে ঘাটতি থাকছে ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট, যা স্পট মার্কেট থেকে ক্রয় করা হয়। রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের ফলে বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম বেড়ে যাওয়ায় স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস কেনা বন্ধ করে দেয় সরকার। পরিস্থিতি সামাল দিতে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন কমিয়ে আনা হয়েছে। এক পর্যায়ে সারাদেশে সপ্তাহে একদিন ডিজেল সহ জ্বালানী তেলের পাম্পগুলো বন্ধ রাখা হয়।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালে দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা দাঁড়াবে ৪৪০ কোটি ঘনফুট। কিন্তু সেই অনুপাতে বাড়ছে না গ্যাসের উৎপাদন। নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত না হলে ২০২২-২৩ সালে দেশের ক্ষেত্রগুলো থেকে দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ১৮ দশমিক ৪ কোটি ঘনফুট এবং ২০২৩-২৪ সালে দৈনিক উৎপাদন ৪৩ দশমিক ৫ কোটি ঘনফুট কমে যেতে পারে।
১৯৯৫ সালের জ্বালানী নীতিমালা অনুযায়ী, বছরে ৪টি অনুসন্ধান কূপ খননের কথা বলা হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, গত ১৩ বছরে মাত্র ১৭টি কূপে অনুসন্ধান চালানো হয়েছে। জ্বালানী মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্যে গত ৫ বছরে গ্যাস উত্তোলনে গৃহীত পদক্ষেপ সমূহের চিত্রে দেখা যায়, উন্নয়ন কূপ খনন হয়েছে মাত্র ৬টি।
এছাড়া দেশের সমুদ্রসীমার মধ্যে বিপুল পরিমাণ গ্যাস ও খনিজ সম্পদের সম্ভাবনা থাকলেও সরকার পক্ষ থেকে অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে কোনো তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
দেখা যাচ্ছে, গত এক যুগ ধরে সরকার তেল গ্যাস অনুসন্ধান না করে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে অস্বাভাবিক উচ্চমূল্যে জ্বালানী ক্রয় করেছে। এক্ষেত্রে বিস্তর কমিশনবাণিজ্য ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। আর এটা অব্যাহত রাখতে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে দীর্ঘকাল যাবৎ সেগুলোর পেছনে বৈদেশিক মুদ্রা ঢালা হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন না করা সত্বেও অনেক কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে অর্থ প্রদান করা হচ্ছে, যার পরিমাণ হাজার হাজার কোটি টাকা। কুইক রেন্টাল থেকে অবৈধ পন্থায় অর্থ কামাই করে জনৈক ব্যক্তি সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হওয়ার খবর মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। অথচ জ্বালানীর অভাবে এক পর্যায়ে চট্টগ্রামের সারকারখানা বন্ধ হয়ে যায়। গ্যাসের অভাবে টেক্সটাইল শিল্পে উৎপাদন প্রায় ৬০ শতাংশ কমে গেছে। জ্বালানীর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ফলে বেড়েছে বিদ্যুতের দাম। ফলে বেড়েছে লোডশেডিং। এতে কলকারখানায় যেমন উৎপাদনে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে, তেমনি জনজীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্ভোগ ও আর্থিক অনটন। বেড়েছে প্রতিটি খাদ্যপণ্যের দাম। এসব দুর্ভোগের মূলে আছে জ্বালানীর সংকট ও মূল্যবৃদ্ধি। কিন্তু স্থায়ীভাবে দেশীয় উৎস থেকে এই সংকট দুরীকরণের জন্য কোন টেকসই ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেই কর্তৃপক্ষের, যা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক।