একটি ঐতিহ্যবাহী শিল্পের করুণ মৃত্যু
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:১৮:০১ অপরাহ্ন
দেশের মুদ্রণ শিল্পে এখন মারাত্মক সংকট লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এজন্য কাগজের সংকট মূলতঃ দায়ী। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, গ্যাস ও নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুতের অভাবে কাগজ সংকট চলছে বেশ আগে থেকেই। এ অবস্থায় সম্প্রতি একটি জাতীয় মিডিয়ায় ‘কর্ণফুলী পেপার মিল ঃ পুরোপুরি বন্ধ উৎপাদন, ৩ হাজার টন কাগজের ক্রেতা নেই’ শীর্ষক একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, প্রায় ৭০ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী কাগজ উৎপাদন কারখানা কর্ণফুলী পেপার মিল (কেপিএম) পুরোনো যন্ত্রপাতি, প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্তহীনতা, পাল্প সংকট প্রভৃতি কারণে এখন পুরোপুরি বন্ধ। সবশেষ পুরোনো কাগজ থেকে কিছু উৎপাদন হয়েছিলো গত আগস্ট মাসে। বয়সের ভারে ন্যুব্জ মিলটি দেনায় জর্জরিত। এর মধ্যে আছে ৩ হাজার টন অবিক্রিত কাগজের বোঝা। দেশে চরম কাগজ সংকটের সময়েও পাঠ্যবই ছাপার উপযোগী এসব কাগজ কাজে লাগানো হচ্ছে না। দেশে যখন কাগজের চরম সংকট চলছে তখন কর্ণফুলী পেপার মিলে এতো বিপুল পরিমাণ কাগজ অপাংক্তেয় অবস্থায় পড়ে থাকার বিষয়টি যুগপৎ বিস্ময়কর ও হতাশাব্যঞ্জক।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এনসিটিবি’র জন্য কাগজগুলো বিশেষভাবে তৈরী করা হয়েছিলো। এসব কাগজ অন্য প্রতিষ্ঠানে তেমন ব্যবহার করা হয় না। যে কারণে সহজে বিক্রি করা যাচ্ছে না এগুলো। একদিকে চরম ঘাটতি ও সংকট অপরদিকে অপচয়ের জ্বলন্ত উদাহরণ এই ৩ হাজার টন কাগজ। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) তাদের বইয়ের জন্য সব কাগজ কর্ণফুলী পেপার মিল থেকে সংগ্রহ করতো। প্রতি বছর এনসিটিবি কর্ণফুলী থেকে আড়াই হতে ৩ হাজার টন কাগজ নিতো। এনসিটিবিকে প্রয়োজনীয় কাগজ সরবরাহের লক্ষ্যে অর্ডার ছাড়াই প্রায় ৫ হাজার টন কাগজ তৈরী করে মিলটি। ২০২০-২১ সালে এনসিটিবি এক হাজার টন কাগজের অর্ডার দেয়। পরবর্তী ২ অর্থ বছরে কাগজ অর্ডার বন্ধ করে দেয় এনসিটিবি, ফলে এই কাগজ নিয়ে বিপাকে পড়েছে কর্ণফুলী পেপার মিল।
লক্ষণীয় যে, ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন সংস্থা রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোণায় কর্ণফুলী পেপার মিল লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করে। প্রাথমিক পর্যায়ে মিলটি আমেরিকা, ইংল্যা-, সুইডেন ও ইতালির সহযোগিতা এবং বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তায় স্থাপিত হয়। ঐ সময় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের কাগজের চাহিদার প্রায় শতভাগ সরবরাহ করা হতো কর্ণফুলী পেপার মিল থেকেই। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশেও এই মিলে উৎপাদিত কাগজ অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পায়। তবে বিগত দুই যুগে দেশে বেসরকারী পেপার মিল প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বিদেশ থেকে কাগজ আমদানি শুরু হলে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে রাষ্ট্রীয় বৃহৎ কাগজ কলটি। ২০১৬ সালে বন্ধ হয়ে যায় কর্ণফুলী পেপার মিলের কাঁচামাল অর্থাৎ পাল্প বা মন্ড তৈরীর প্লান্ট। নিজস্ব সোর্স থেকে সংগৃহীত বাঁশ ও পাল্পউড দিয়ে মন্ড তৈরী করা হতো মিলে। সেই মন্ড দিয়ে তৈরী হতো কাগজ। লেখার কাগজ, মুদ্রণের কাগজ, করোগেটেড বোর্ড, মোমের প্রলেপযুক্ত কাগজ, আঠাযুক্ত ফিতা ও বিটুমিন কাগজ তৈরীতেও সক্ষম ছিলো কর্ণফুলী পেপার মিল। মিলের কাঁচামাল হিসেবে নিজস্ব কূপ এরিয়ায় স্থানীয়ভাবে বাঁশ উৎপাদন হতো। বাঁশ থেকে কাগজ উৎপাদনে প্রতি টনে ১৮-২০ হাজার টাকা ব্যয় হতো। কিন্তু ২০১৭ সালে নানান সমস্যা দেখিয়ে নিজস্ব কূপ থেকে আহরিত কাঁচামাল ও পাল্পউড দিয়ে কাগজ উৎপাদন বন্ধ করে দেয় মিলটি। বাঁশ ও পাল্ডউড সংগ্রহ বন্ধ করে পুরোনো কাগজ ও আমদানি করা পাল্প ব্যবহার করার কারণে কাগজের উৎপাদন খরচ কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
সংশ্লিষ্ট মহলের অভিযোগ, বাইরে থেকে কাঁচামাল আমদানি ও বেসরকারী মিলগুলোকে সুবিধা দিতে একটি মহলের চক্রান্তে দেশের এই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত ঐতিহ্যবাহী কাগজের মিলটি বন্ধ করে দেয়া হয়। একদিকে স্বনির্ভরতা ও উন্নয়নের কথা বলা হলেও এই ঐতিহ্যবাহী মিলটিকে চালুর উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। বরং বিদেশ থেকে অত্যধিক মূল্যে কাগজ আমদানি ও বিদেশে পাঠ্যবই মুদ্রণে আগ্রহী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এতে জটিলতা ও বৈদেশিক মুদ্রার সংকট আরো বাড়ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে সৃষ্টি হচ্ছে অবাঞ্ছিত জটিলতা। দেশের এই মারাত্মক কাগজ সংকটের প্রেক্ষাপটে কর্ণফুলী পেপার মিলটি পুনরায় চালু করা যায় কি-না, তা পরীক্ষা করে দেখার জন্য আমরা শিল্প মন্ত্রণালয় তথা সরকারের উর্ধ্বতন মহলের প্রতি আহবান জানাচ্ছি।