আদানির বিদ্যুৎ গলার ফাঁস!
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ মার্চ ২০২৩, ১২:৩০:৪০ অপরাহ্ন
ইদানিং বিদ্যুৎখাতে ভর্তুকির অজুহাতে উপর্যুপরি বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। বিদ্যুতের দাম না বাড়ালে সরকারকে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে, এমন দাবি সরকারের। কিন্তু ভারতীয় কোম্পানী আদানির সাথে অন্যায় ও অসম বিদ্যুৎ চুক্তির ফলে প্রতি বছর যে হাজার হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারকে, এ বিষয়টি দিব্যি এড়িয়ে যাচ্ছেন ক্ষমতাসীনরা।
২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রথম বাংলাদেশ সফরের ২ মাসের মাথায় ১১ আগস্ট আদানি পাওয়ার এর সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সই করে পিডিবি। কিন্তু সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের ২ বছর পর ২০১৭ সালে সরকারকে ভারতের ঝাড়খন্ডে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি করে। অথচ দেশে ইতোমধ্যেই কয়েকটি বড়ো বিদুৎ কেন্দ্রের কাজ চলছিলো। এ ব্যাপারে দেশ বিদেশের কয়েকজন বিশেষজ্ঞের অভিমত হচ্ছে, চুক্তিটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং শুধু মাত্র আদানি গ্রুপের সুযোগ সুবিধা বিবেচনা করেই তা করা হয়েছে।
সিডনি ভিত্তিক ক্লাইমেট এনার্জি ফাইন্যান্স, অষ্ট্রেলিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ টিম বাকলি বলেছেন, এক কথায় এই চুক্তিটিতে কেবল আদানিই জিতেছে। এই চুক্তিটি এতোটাই বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী যে, আমি ভাবছি, কোন সচেতন মানুষ কেনো বাংলাদেশের পক্ষে এই চুক্তিটি সই করবেন।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্টজন গৌতম আদানির প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে করা চুক্তির সবচেয়ে লুন্ঠনমূলক দিক রয়েছে কয়লার দাম ও ক্যাপাসিটি চার্জ অর্থাৎ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়ার মধ্যে। আর যে কয়লা দিয়ে আল্ট্রাসুপারক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির এই পাওয়ার প্লান্টে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে তার দাম নির্ধারণ করা হবে ইন্দোনেশিয়ার কয়লা সূচক ও অস্ট্রেলিয়ান নিউক্যাসল সূচক অনুযায়ী। দু’টো সূচকের গড় দামে প্রতি কেজি ৬৩৩২ কিলোক্যালরি মানের কয়লার দাম যা হবে, তার ভিত্তিতে ওই মাসের কয়লার দাম নির্ধারণ করা হবে। এর অর্থ হলো, আদানি পাওয়ার যদি অন্য দেশ থেকে কম দামে কয়লা কিনে, আর সূচকের দাম বেশি থাকে, তবুও তারা বেশি দাম নিতে পারবে। অভিযোগ রয়েছে, কয়লার ক্যালোরিফিক মান তারা কম করে ধরেছে, যাতে বেশি পরিমান কয়লা ব্যবহার করতে হয়।
পিপিএ’তে উল্লেখ করা হয়েছে, পিডিবির কাছে কেজি প্রতি ৪৬০০ কিলোক্যালারি মানের কয়লার দাম নেবে আদানি। এ প্রসঙ্গে টিম বাকলি বলেন, আদানি যে কয়লা ব্যবহার করবে, সেই গুণমানের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, এমন একটি সূচকে যদি দাম নির্ধারণ করা হয়, তাহলে কীভাবে সেটা ন্যায্য হতে পারে? এছাড়া আদানি পাওয়ারের সঙ্গে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী, কোন যুদ্ধ বিগ্রহ বা দৈব দুর্ঘটনায় বাংলাদেশ যদি বিদ্যুৎ না নিতে পারে তবুও ক্যাপাসিটি চার্জ ও জরিমানাসহ সবধরণের পাওনা তাদের দিতেই হবে। কিন্তু এই কারণে যদি তারা বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে না পারে তবে পিডিবিকে কোন ধরণের ক্ষতিপূরণ দিতে তারা বাধ্য নয়। রাজনৈতিক কোন কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেটা মেরামত ও এ সংশ্লিষ্ট সব ব্যয় পিডিবিকে দিতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে যে ১ হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে, তা বাংলাদেশের গ্রহণ করতে পারার সম্ভাবনা খুবই কম। আদানির এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ডেডিকেটেভ ট্রান্সমিশন লাইন বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুৎ নিয়ে আসবে, যেটি শিল্পঘন অঞ্চল নয় এবং সেখানে এতো বেশি বিদ্যুতের চাহিদাও নেই। ফলে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি অব্যবহৃতই রাখতে হবে এবং ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে ডলার দিয়ে যেতে হবে।
বলা যায়, পুরো চুক্তিটি মোদীর ঘনিষ্টজন আদানিকে বাংলাদেশ সরকারের দেয়া একটি উপহার ছাড়া আর কিছুই নয়। সর্বোপরি, যে পরিমাণ বিদ্যুতের জন্য চরম অস্বাভাবিক মূল্য ও দায় নিয়ে সরকার এই চুক্তিটি করেছে, সেই বিদ্যুতের কোন প্রয়োজন নেই বাংলাদেশের। কারণ বর্তমানে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে, তা দেশের বিদ্যুতের মোট চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতিক ভাষ্যকর অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, ভারত বা মোদী খুশি থাকলে আমাদের আপত্তি থাকার কথা না। কিন্তু তা যদি হয় বাংলাদেশের স্বার্থের বিনিময়ে এবং তাঁকে খুশি করতে গিয়ে যদি বাংলাদেশের মানুষকে বাড়তি বিদ্যুতের দাম পরিশোধ করতে হয় বছরের পর বছর তাহলে অবশ্যই আমাদের প্রতিবাদ করতে হবে।