দুঃখ প্রকাশের জায়গাও নেই
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ মার্চ ২০২৩, ১২:৩০:৫৩ অপরাহ্ন
গত বছরের আগস্টে ডিমের ডজন ১৩০ টাকা থেকে বেড়ে ১৮০ টাকা এবং ব্রয়লার মুরগীর কেজি দেড়শ টাকা থেকে দু’শ টাকা হলে দেশের স্বল্প আয়ের মানুষের মাঝে যুগপৎ ক্ষোভ ও হতাশা সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে মিডিয়ায় সংবাদ ও প্রতিবেদন প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়। এসব সংবাদ ও প্রতিবেদনে সীমিত আয়ের ভুক্তভোগী মানুষের মতামত ও দুর্ভোগের কথা উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু এতে ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতামন্ত্রী ক্ষেপে যান। অনেকে হাসি তামাশা ও রসিকতা করেন দ্রব্যমূল্য নিয়ে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঐ সময় তার বক্তব্যে ‘দেশের মানুষ বেহেশতে আছে’ বলে মন্তব্য করলে দেশব্যাপী আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রী বলেন, এখনো মানুষের গায়ে কাপড় চোপড় আছে, এতে বুঝা যায় তারা ভালোই আছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর এমন বক্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে জনৈক দরিদ্র ব্যক্তি মন্তব্য করেন, আমরা কি আমাদের আর্থিক দুর্দশার কথা বুঝাতে উলঙ্গ হয়ে দেখাতে হবে?
এসব আলোচন সমালোচনা ও মন্তব্যের পর ৬ মাসেরও বেশী সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। সাধারণ মানুষের আর্থিক সমস্যা আরো বেড়েছে। এখন ক্ষমতাসীনদের বেশীর ভাগই চুপ মেরে গেলেও কেউ কেউ বুঝাতে চাইছেন, দেশের অর্থনীতি অনেক ভালো আছে। বিশ্বের আরো অনেক দেশের তুলনায় আমরা ভালো আছি।
গত শুক্রবার একটি জাতীয় দৈনিকে ‘যেভাবে চলছে নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তের সংসার’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, প্রয়োজনীয় অনেক কিছু কাঁটছাট করেও খরচ সামাল দিতে পারছেন না অনেকে। গতকাল স্থানীয় দৈনিক জালালাবাদে ‘অসহনীয় বাজার চাপে মধ্যবিত্ত’ শীর্ষক একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়েছে, মুদী বাজারে সপ্তাহের ব্যবধানে নতুন করে বেড়েছে ডাল ও ছোলার দাম। চিনির সংকট এখনো কাটেনি। জনৈক মুদী দোকানীর বক্তব্য তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনটিতে। তিনি বলেন, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে শুধু ক্রেতা নয় আমরা বিক্রেতারাও বিব্রত। অনেক পরিচিত ক্রেতা যেখানে এক কেজি ডাল কিনতেন, সেখানে তিনি মাত্র ২৫০ গ্রাম ডাল কিনতে আসছেন। এতে আমাদের লাভ অনেক কমেছে। ৫০০ টাকা দামের পণ্য বিক্রি করে আগে যেখানে ৫০-৬০ টাকা লাভ হতো, সেখানে ১০-২০ টাকা লাভ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। আমাদের দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ বিলসহ সকল খরচ বেড়েছে। আমরা কার কাছে বলবো।
একই দিনের স্থানীয় আরেকটি দৈনিকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পবিত্র রমজান মাস আসার আগেই নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়। আর এই পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার প্রতি বছর নানা রকম অঙ্গীকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে। কিন্তু বরাবরই দেখা যায় বাজার নিয়ন্ত্রণে আসে না। বাজারের নাটাই থাকে অশুভ চক্রের হাতে। বিশেষভাবে এবার ডলার সংকট ও এলসি খোলায় নানা জটিলতার কারণে পণ্যের মূল্য বেড়ে গেছে। এ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ শুরু হচ্ছে রমজান মাস।
পবিত্র এ মাসকে কেন্দ্র করে ভোজ্য তেল, আটা, ময়দা, ডাল, ছোলা, চিনি, পেঁয়াজ ও খেজুরের মতো অনেক ভোগ্য পণ্যের চাহিদা আগেভাগেই কয়েক গুণ বেড়ে যায়। এসব পণ্যের বেশীর ভাগই আমদানি করতে হয়। তাই আমদানিও অনেক বৃদ্ধি পায়। এ বছর ডলার সংকট ও এলসি খোলায় নানা জটিলতার কারণে এসব পণ্য আমদানির পরিমাণ অনেক কমে গেছে। ফলে জোগান কম হওয়ায় দাম হবে উর্ধ্বমুখী। এ কারণে রমজানে নিত্যপণ্য ক্রয়ে এবার অনেক বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হবে সাধারণ ভোক্তাদের। মধ্যবিত্ত ও ভোক্তা ক্রেতাদের বক্তব্য হচ্ছে, বাজারের প্রায় সব পণ্যের দাম চড়া, ফলে সবচেয়ে বেশী কষ্টে আছেন তারা। জনৈক মধ্যবিত্ত ভোক্তা বলেন, আমরা মধ্যবিত্তদের কষ্টটাই বেশী। এক সাথে সব কিছুর দাম এতোটা বেড়ে যাওয়া যেনো আমাদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। না পারছি কিছু ভালোমতে কিনতে, না পারছি না খেয়ে থাকতে। যারা একেবারে গরীব তারা আমাদের চেয়ে ভালো আছেন। অন্ততঃ মানুষের কাছে হাত পেতে হলেও ভালো-মন্দ খেয়ে চলতে পারছেন। আমাদের তো তা করার জো নেই। আর বড়লোকদের কথা তো বলেই লাভ নেই। উনাদের এসবের দাম বাড়া-কমা নিয়ে কোন চিন্তাই নেই।
পণ্যমূল্য বৃদ্ধির সংকটের সাথে আগামী মাসগুলোতে আরেকটি সংকট যোগ হচ্ছে এবার। এবার গ্রীষ্মে লোডশেডিং অনেক বেশী হওয়ার আশংকা রয়েছে। এর প্রধান কারণ জ্বালানী সংকট। পাওয়ার সেল এর সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমত উল্লাহ বলেন, গরমের সময় লোডশেডিং এবারও হবে। তার কারণ হলো তার মূল কারণ জ্বালানী সংকট তো থেকেই যাচ্ছে। আমাদের দেশে উৎপাদিত গ্যাসের ক্রাইসিস আছে। এলএনজি বা এলপিজি’র দাম অনেক চড়া; কেনার সেই অর্থ আমাদের নেই। কয়লা যদি কিনতে হয়, অনেক টাকা, সেটাও নেই। তেলের দামও চড়া, সেখানেও পয়সা নেই, ডলারের দামও বেশী। এসব মিলে আর বিতরণ ব্যবস্থা মিলিয়ে আমার মনে হয়, এবার গরমে তীব্র সংকট দেখা দেয়ার আশংকা আছে। অনেক সংকট, কিন্তু এসব সংকটের সমাধান করা খুব কঠিন। কথা হচ্ছে, মাত্র এক বছর আগেও ক্ষমতাসীন নেতানেত্রী সরকারের উর্ধ্বতন মন্ত্রী আমলারা দেশ সিঙ্গাপুর কানাডাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে উন্নত ও সমৃদ্ধিতে এবং বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল এবং দেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে কিংবা উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে বলে বগল বাজিয়েছিলেন, একথা দেশের জনগণের ভালোই মনে আছে। কিন্তু হঠাৎ এই উন্নয়নের জোয়ারে ভাসা ও বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল বাংলাদেশের এতো শক্তিশালী অর্থনীতি কেনো ললাটে গুলিবিদ্ধ হাতির মতো ভুলুণ্ঠিত হয়ে পড়লো, এর জবাব কি তারা দেবেন? এমন প্রশ্ন সচেতন মহলের। বলা হচ্ছে, রুশ-ইউক্রেইন যুদ্ধের ফলে এই বিপর্যয়। কিন্তু রুশ-ইউক্রেইন যুদ্ধের প্রভাব কি শুধুমাত্র বাংলাদেশেই অনুভূত হওয়ার কথা? সাথে সাথে এমন প্রশ্নও তাদের। প্রতিবেশী ভারতের দরিদ্র অঙ্গরাজ্য লাগোয়া দেশ পশ্চিমবঙ্গে তো এতো আর্থিক সংকট নেই। এ ধরনের সংকট নেই প্রতিবেশী যুদ্ধবিধ্বস্ত মিয়ানমার কিংবা থাইল্যা- বা ভিয়েতনামেও। এমনকি সার্কভুক্ত দেশ নেপাল, ভূটানেও এমন অর্থনৈতিক দুরবস্থা দেখা যাচ্ছে না। যেমনটি দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে।
প্রকৃতপক্ষে এসব সমস্যার মূলে আছে দুর্নীতি বিশেষভাবে অর্থ পাচার। এই দুর্নীতি ও অর্থ পাচার দেশের অর্থনীতিকে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। তাই উন্নয়নের জোয়ারে ভাসা দেশে এখন শুধু ‘নেই আর নেই’। কিন্তু এ অবস্থায়ও লুটেরা দুর্নীতিবাজ ক্ষমতাসীন ক্ষমতাধরদের কোন অসুবিধা হচ্ছেনা। যতো সমস্যা হচ্ছে নি¤œবিত্ত ও মধ্যবিত্ত তথা সীমিত আয়ের সাধারণ জনগণের। তাদের এসব বলার জায়গাও নেই। যেখানে বলার কথা, সেখানে সমাসীন রক্ষকরূপী ভক্ষক সেই দুর্নীতিবাজ অর্থ পাচারকারীরা।