এক আগ্রাসী জলজ উদ্ভিদের কাহিনী
প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ মার্চ ২০২৩, ১২:৩৫:১৯ অপরাহ্ন
কথায় কথায় অনেকে বলেন, আমি কি কচুরিপানার মতো ভেসে এসেছি? কেউ কাউকে অবহেলা বা উপেক্ষা করলে উপেক্ষিত ব্যক্তি দুঃখবোধ থেকে কিংবা অনুযোগের সুরে এমন কথা বলে থাকেন। এখানে কচুরিপানাকে সহজলভ্য ও সস্তা জিনিস বলে বুঝানো হয়েছে। ইতোপূর্বে পরিকল্পনামন্ত্রী কচুরিপানা ব্যবহারের কথা বলতে গিয়ে সমালোচকদের তোপের মুখে পড়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশে কচুরিপানা এখন আর আগের মতো অবহেলিত নয়। এই দ্রুত বর্ধনশীল আগাছা ব্যবহৃত হচ্ছে হস্তশিল্পে, বিভিন্ন নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রী তৈরীতে। এই কচুরিপানাকে কেন্দ্র করে দেশের কিশোরগঞ্জ ও নরসিংদীসহ বিভিন্ন জেলায় বহু হস্তশিল্প কারখানা গড়ে ওঠেছে। এসব কারখানায় শত শত নারী ও পুরুষ শ্রমিক কাজ করছেন। তারা হোগলা, শন, পাট, নেপিয়ার, ঘাস ও কচুরীপানা দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ঝুড়ি ও অন্যান্য সামগ্রী তৈরী করছেন। এক সময় কচুরীপানা ছিলো শুধুই গরুর খাবার কিংবা গাছের জৈব সার। এছাড়া এটাকে ক্ষতিকর জিনিস হিসেবে দেখা হতো। অনেক সময় পুকুর ও জলাশয়ের পানিতে কচুরিপানা জন্মানোর ফলে সেই পুকুর ও জলাশয়ের পানি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়তো। কিন্তু বর্তমানে এই কচুরিপানা বেশ দামে বিক্রি হচ্ছে। ২০২০ সালে কচুরিপানা বাজারে আসতে শুরু করে পুরোদস্তুর পণ্য হিসেবে। হোগলা, শন ও নেপিয়ার ঘাস গরুর খাদ্য ও অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হওয়ায় এগুলোর দাম বরাবরই চড়া, অনেক ক্ষেত্রে দুর্লভও। কিন্তু সেই তুলনায় কচুরি যেমন সহজলভ্য তেমনি সস্তা। তাই তুলনামূলক সস্তা ও সহজলভ্য এই জলজ উদ্ভিদ বা আগাছা শুকিয়ে ঝুড়িসহ বিভিন্ন ধরণের হস্তশিল্প সামগ্রী তৈরী করা হচ্ছে উপরোক্ত কারখানাগুলোতে। এতে হাজার হাজার লোকের বিশেষভাবে মহিলাদের আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এসব সামগ্রী বিদেশেও যাচ্ছে এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে ভূমিকা রাখছে। কচুরিপানার বহুমুখী ব্যবহার নিয়ে দেশে গবেষণা প্রয়োজন বলে মনে করেন সচেতনমহল। কারণ খাল বিল নদী নালার দেশ বাংলাদেশের পুকুর খালবিল ও অন্যান্য জলাশয়ে প্রচুর কচুরিপানা জন্মে, তাই এগুলো এখানে সহজলভ্য। কচুরপানার উপযোগিতা অর্থাৎ ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেকে কচুরিপানা সংগ্রহ করে বাজারে নিয়ে আসছেন বিক্রয়ের জন্য। এভাবে বেশ আয়ও করছেন তারা।
সিলেট অঞ্চলে কচুরিপানাকে ‘জার্মানীর পানা’ বলা হয়। অনেকের মতে, গত বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান সেনারা এই জলজ উদ্ভিদ এই অঞ্চলে নিয়ে আসে। তাই এর নাম হয়ে যায় ‘জার্মানীর পানা’। এখনো গ্রামের লোকজনের কাছে কচুরীপানা ‘জার্মানীর পানা’ বা ‘জার্মনীর পানা’ হিসেবে পরিচিত।
শুধু বাংলাদেশ নয়, আরো অনেক দেশে কচুরীপানা শুকিয়ে হস্তশিল্প সামগ্রী তৈরীতে ব্যবহার করা হয়। জানা গেছে, বিগত বছরগুলোতে এশীয় দেশ কম্বোডিয়ার অনেক দরিদ্র নারী পুরুষের ভাগ্য বদলে দিয়েছে এই আগ্রাসী প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ ওয়াটার হায়াসিন্থ অর্থাৎ কচুরিপানা। কম্বোডিয়ার উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় ‘টনলে স্যাপ’ লেকে প্রচুর কচুরিপানা জন্মে। অনেক স্থানীয় লোক বিশেষভাবে মহিলারা এই কচুরিপানা তুলে এনে ঝুঁড়ি ও মাদুরসহ অন্যান্য হস্তশিল্প সামগ্রী তৈরী করে। কম্বোডিয়ার জনৈক পরিবেশবিদের মতে, কচুরিপানার এ ধরনের ব্যবহার পরিবেশ রক্ষায় সহায়ক। যে জলাশয়ে কচুরিপানা জন্মে সেই জলাশয়ের পানিতে অক্সিজেন কমে যায়। কচুরিপানা পানিতে সূর্যের আলো প্রবেশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এভাবে মাছসহ জলজ প্রাণী অক্সিজেনশূন্য হয়ে মারা যায়। এ ধরনের জলাশয়ে মাছের বংশবৃদ্ধিও মুশকিল হয়ে পড়ে। তাই বিকল্প ব্যবহারের কাজে জলাশয় থেকে কচুরিপানা সংগ্রহ করা হলে সেই জলাশয়ের পানি যেমন অক্সিজেন স্বল্পতা বা শূন্যতা থেকে রক্ষা পায়, তেমনি দরিদ্র মানুষের আয়ের একটি উপায় সৃষ্টি হয়।
যা-ই হোক, এক সময়ে আগ্রাসী জলজ উদ্ভিদ ও ক্ষতিকর জিনিস হিসেবে পরিগণিত ও পরিচিত কচুরিপানার ব্যবহার খাল বিল নদী নালা ও জলাশয়ের দেশ বাংলাদেশে বহুমুখী হোক, এমন প্রত্যাশা আমাদের। এ নিয়ে উদ্ভিদ বিজ্ঞানীসহ বিশেষজ্ঞরা আরো গবেষণা করবেন, সচেতন মহল এটাই কামনা করেন।