অর্থনীতি এলোমেলো, শংকিত জনগণ
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ জুন ২০২৩, ১২:৩০:৪৮ অপরাহ্ন
অর্থনৈতিক বিশ্লেষক সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)-এর নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, এ বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা ছাপানো থেকে বিরত থাকতে হবে। গতবার যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নেয়, তখন তারা ডলার বিক্রি করে বাজার থেকে টাকা তুলে নিয়েছিলো। কিন্তু এখন তো আর ডলার বিক্রি করার অবস্থা নেই। ফলে সরকারকে ঋণ নিতে গিয়ে টাকা ছাপাতে হতে পারে। কিন্তু এতে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাবে। তিনি আরো বলেন, মূদ্রানীতির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সহযোগিতা করা। এখন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নেই। তাহলে মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি কীভাবে হবে। অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য প্রয়োজন বেরসকারী খাতের বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি। কিন্তু মূল্যস্ফীতি, ডলার ও তারল্য সংকট, আমদানি কমে যাওয়া ইত্যাদি কারণে বিনিয়োগ কমে গেছে। ফলে বর্তমানে মূদ্রানীতিতে সবচেয়ে গুরুত্ব পাওয়া উচিত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার বিষয়টি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হারের ব্যবহার এখনো আমরা দেখিনি। এছাড়া ব্যাংকের তারল্য কমে যাওয়া, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া, মুদ্রার বিনিময় হারের অস্থিতিশীলতা, প্রবাসী আয় কমে যাওয়া ইত্যাদি চ্যালেঞ্জ ও রয়েছে। ফলে এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়েই নতুন মূদ্রানীতি প্রণয়ন করা প্রয়োজন।
লক্ষণীয় যে, বর্তমানে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৯ শতাংশের মতো, আর সুদের হার ৯ শতাংশ। দু’টি প্রায় সমান। আবার মূদ্রার বিনিময় হার কয়েকটি হওয়ার কারণে বাজারে ভুল বার্তা যাচ্ছে এবং ডলারের বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না। আবার বড়ো বড়ো ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে সুবিধা দেয়ার জন্য সুদের হার কমানো হচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে ডলার সংকটে দেশের আর্থিক হিসাব এখন এলোমেলো। বৈদেশিক মুদ্রায় আয়ের তুলনায় ব্যয় বেড়েছে অনেক বেশী। এতেই আর্থিক হিসাবে দেখা দিয়েছে বড়ো ঘাটতি। গত এক যুগের মধ্যে এটাই প্রথম ও ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো ঘাটতি। মুলত একটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উঠানামা নির্ভর করে এই আর্থিক হিসাবের উপর। এই ঘাটতির কারণেই রিজার্ভও ক্রমাগত কমছে। দেশে এখন প্রবাসী আয়ের পুরোটাই দিনে দিনে দেশে চলে আসে। রফতানি যা হয়, তার বড়ো অংশ খরচ হয়ে যায় কাঁচামাল আমদানিতে। আবার সব রফতানি আয় সময় মতো দেশেও আসে না। এর বাইরে দেশে ডলার আয়ের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে বিদেশী ঋণ, অনুদান ও বৈদেশিক বিনিয়োগ। এছাড়া বেসরকারী খাতের ব্যবসায়ীরা আমদানিতে বিদেশী প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়েছেন। এটা এখন কমতির দিকে। বরং ডলারের দাম বাড়তে থাকায় উল্টো বিদেশী ঋণ শোধ করার প্রবণতা বেড়ে গেছে এবং আর্থিক হিসাবে ঘাটতি তৈরি হয়েছে। ফলে ডলারের ওপর চাপ কমছে না, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন ও থামানো যাচ্ছে না। ডলারের দাম এখনো ব্যাংকগুলো আটকে রেখেছে। এই দাম শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে, কেউ তা বলতে পারছেন না।
বলা বাহুল্য, দেশের অর্থনীতি আগেও খুব মজবুত ছিলো না। এ অবস্থায় প্রথমে করোনা মহামারি এবং পরে ইউক্রেন যুদ্ধ এসে এই অবস্থাকে রীতিমতো ভঙ্গুর করে দেয়। সর্বোপরি সীমাহীন দুর্নীতি বিশেষভাবে অর্থ পাচার এবং উৎপাদনমুখী খাতের পরিবর্তে লুটপাটধর্মী মেগা প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ করে এই অবস্থাকে ধ্বংসের কিনারায় এনে দাঁড় করানো হয়েছে। ফলে ডলার সংকট ও মূদ্রাস্ফীতি এখন অর্থনীতিকে গ্রাস করেছে। সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক এ অবস্থায় নতুন টাকা না ছাপার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু মিডিয়ায় নতুন নোট বাজারে আসার খবর প্রকাশিত হয়েছে। এতে পণ্যমূল্য আরো যে বাড়বে, এতে কোন সন্দেহ নেই। এ অবস্থায় দেশের অর্থনীতির পাগলা ঘোড়াকে নিয়ন্ত্রণে আনার ক্ষমতা কিংবা সদিচ্ছা সরকারের আছে কি-না, এ ব্যাপারে সচেতন মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা এসব বিষয়ে হুশিয়ারির পাশাপাশি তাদের শংকার কথা বার বার ব্যক্ত করে চলেছেন।