ভয়াবহ বায়ুদূষণ বিপন্ন জীবন
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:৩০:১১ অপরাহ্ন
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে হৃদরোগের অন্যতম প্রধান একটি কারণ হচ্ছে বায়ূদূষণ। ইতোপূর্বে গৃহীত এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বায়ূদূষণ ছিলো বাংলাদেশে মৃত্যু ও অক্ষমতার দ্বিতীয় প্রধান বড় কারণ। ওই বছর প্রায় ৮৮ হাজার মৃত্যুর জন্য বায়ূদূষণকে দায়ী করা হয়। বায়ূদূষণ শারীরিক অসুস্থতা সৃষ্টির পাশাপাশি মানসিক সমস্যাও সৃষ্টি করে বলে চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের অভিমত। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে দূষণপ্রবণ এলাকাগুলোর প্রায় ১৪ শতাংশ বাসিন্দা বিষন্নতায় ভুগছেন। বায়ুদুষণের শারীরিক ও মানসিক প্রভাব নিয়ে বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশী বায়ূদূষণ হচ্ছে ঢাকায়। ঢাকায় যানজট ও নির্মাণাধীন প্রকল্পের কারণে যে পরিমাণ বায়ূদূষণ হয়, তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বায়ূমানের চেয়ে ১৫০ শতাংশ বেশী এবং ইটভাটার কারণে যে দূষণ হয় তা ১৩৬ শতাংশ বেশী। সিলেটে সবচেয়ে কম দূষণ হচ্ছে বলা হলেও এখানকার বাতাসও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বায়ূমানের চেয়ে ৮০ শতাংশ বেশী দূষিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মাত্রা থেকে ১ শতাংশ দূষণ বাড়লে বিষন্নতায় ভোগা মানুষের সংখ্যা ২০ গুণ বেড়ে যেতে পারে। গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকায় সারা দিনে একজন মানুষ যে পরিমাণ দূষিত বায়ূ গ্রহণ করেন, তা প্রায় ২ টি সিগারেট খাওয়ার সমান ক্ষতিকর।
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষ যে প্রকৃতি ও পরিবেশে বসবাস করছে, সেটির ভারসাম্য না থাকলে মানসিক চাপ তৈরী হয়, যা মানুষের ‘ওয়েল বিইং’ বা ‘ভালো থাকা’কে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তবে শুধু বায়ূদূষণই যে বড় ধরনের মানসিক রোগ সৃষ্টি করে, এমন নয়। বরং যারা অল্পতে উদ্বিগ্ন হন, তাদের মানসিক চাপ, উদ্বেগ বা বিষন্নতা বায়ূ দূষণের ফলে তীব্র হয়ে ওঠে। যার কারণে মনোযোগ সমস্যা হতে পারে, মেজাজ খিটখিটে হতে পারে। উৎপাদনশীলতা কমে যেতে পারে। এমনকি অতিরিক্ত বায়ূদূষণে খারাপ প্রভাব পড়তে পারে মানুষের প্রজনন ক্ষমতার ওপরও।
গত বছর এক নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৫৪ জেলারই বায়ুর মান আদর্শ মাত্রার চেয়ে খারাপ। আদর্শ মাত্রার মধ্যে আছে মাত্র ১০টি জেলার বায়ুর মান। গবেষণায় অতিরিক্ত দূষিত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে বাংলাদেশের ১৮টি জেলাকে। সর্বোচ্চ বায়ূদূষণ পরিমাপ করা হয় গাজীপুরে, এর পরেই আছে ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জ, যেখানে বায়ূতে অতি ক্ষুদ্র কর্নার মাত্রা বাংলাদেশের আদর্শ মান প্রতি ঘনমিটারে ৬৫ মাইক্রোগ্রামের চেয়ে ৪ থেকে ৫ গুণ বেশী। আর বায়ূদূষণের জন্য দায়ী যে অতি ক্ষুদ্র কণা সেটি আদর্শ মাত্রায় আছে কেবল ১০টি জেলায়। সর্বনিম্ন বায়ূদূষণ পরিমাপ করা হয়েছে মাদারিপুর, পটুয়াখালি ও মেহেরপুরে। এই অতি ক্ষুদ্র কনা বলতে ২.৫ মাইক্রন বা তার কম আকারের বস্তুকনার কথা বলা হয়েছে। তারা এসব জেলার প্রতিটিতে ২.৫ মাইক্রন বা তার কম আকারের ধূলিকনার ব্যাপকতা পরিমাপ করেছেন।
বলা বাহুল্য, একটি চুলের সাথে তুলনা করলে এসব ধূলিকনার আকার চুলের প্রায় ২০ ভাগের এক ভাগের সমান, যা সহজেই মানবদেহে প্রবেশ করে নানা অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে আক্রান্ত করতে পারে।
লক্ষণীয় যে, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা বিশ্বের শীর্ষ বায়ূদূষণযুক্ত নগরী। এজন্য গাড়ির ধোঁয়া ও নির্মাণক্ষেত্রের ধূলোবালির সাথে সীমান্তের বাইরে থেকে বাতাসে ভেসে আসা বিভিন্ন বস্তুকণাও দায়ী। গবেষকদের মতে, রাজধানীর বায়ু দূষণের জন্য প্রায় ৩০ ভাগ দায়ী ভারত ও মিয়ানমারের মতো প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা এসব অতিসুক্ষ্ম পদার্থ। এসব পদার্থের মধ্যে রয়েছে অ্যামোনিয়া, নাইট্রিক অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড, সীসা, কার্বন, ভোলাটাইল অর্গানিক কম্পাউন্ড, ওজোন গ্যাস ইত্যাদি।
এদিকে শুষ্ক মৌসুম আসন্ন। এ সময়ে বায়ূদূষন বৃদ্ধি পায়। বৃষ্টিপাত থেমে যাওয়ার ফলে এ সময় বাতাসে দূষণের মাত্রা বছরের অন্যান্য সময়ের চেয়ে বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। তাই এ সময়ে বায়ূদূষণ থেকে বাঁচার জন্য প্রয়োজনীয় সকল উদ্যোগ নিতে হবে ব্যক্তিগত ও সরকারী সকল পর্যায়ে। এজন্য প্রয়োজন সরকারী পর্যায়ে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। শুধু মাস্ক বা মুখোশ পরিধান করেই এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। সমস্যার গোঁড়ায় গিয়ে সমাধান করতে হবে। আমরা এদিকে সরকারের উর্ধ্বতন মহলের দৃষ্টি ও মনোযোগ আকর্ষণ করছি।