উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে?
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২:৩০:১৮ অপরাহ্ন
গতকাল একটি জাতীয় মিডিয়ায় ‘দেশে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিতে বিশ্বব্যাংকের ভূমিকা আছে’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য প্রদানকালে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে পরিসংখ্যান দেয়, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। ঋণ পুনঃতফশীলীকরণের জন্য খেলাপী ঋণের একটি বড় অংশ আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যানে স্থান পায় না। এই খেলাপী ঋণের বাড়বাড়ন্তের মধ্য দিয়ে দেশে বৈষম্য বাড়ছে। এক পর্যায়ে এই অর্থনীতিবিদ সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে দেশে খেলাপী ঋণের জনক হিসেবে আখ্যা দেন। তিনি বলেন, ওই সময় বিশ্বব্যাংক ও খেলাপী ঋণ তৈরীতে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে। তাদের পরামর্শেই ওই সময় বেসরকারী খাতের উন্নয়নে বিপুল ঋণ দেয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যাংকের ব্যালেন্স শিটের দিকে তাকানো হয়নি। শিল্প ব্যাংক ও শিল্প ঋণ সংস্থার মাধ্যমে দেশের বেসরকারী খাতে ঋণ দেয়া হয়েছে। এরপর তাদের খেলাপী ঋণ বেড়ে গেলে বিশ্বব্যাংক একটি কথাও বলেনি, যদিও পরবর্তীকালে তারাই খেলাপী ঋণের বিষয়ে সোচ্চার। তিনি আরো বলেন, ১৯৮০ এর দশক থেকে শুরু করে ঋণখেলাপীরা ২০২৪ সাল পর্যন্ত ঋণ পুনঃতফশীলের সুবিধা পাচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র একশ্রেণীর মানুষকে বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে, অর্থাৎ আয় বন্টনে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করছে। সেই সঙ্গে এরা কর ছাড়সহ নানা ধরনের ছাড় পেয়েছে। এই ব্যবস্থাকে বৈষম্যমূলক আখ্যা দেন তিনি। তার মতে, এটা অংশতঃ নীতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা।
লক্ষণীয় যে, অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান জিয়াউর রহমানকে দেশে ঋণ খেলাপীর জনক হিসেবে উপস্থাপনের যে চেষ্টা করেছেন, তা যে বিচার বিশ্লেষণবিহীন একপেশে মূল্যায়ন তেমনি শাসকগোষ্ঠীকে খুশী করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। তিনি বিশ্বব্যাংককে খেলাপী ঋণ বৃদ্ধির জন্য দায়ী করেছেন। কোন দেশের ব্যাংকে খেলাপী ঋণ বেড়ে গেলে তা নিয়ন্ত্রণ ও আদায়ের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তথা দেশটির সরকারের। এেেক্ষত্রে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সরকারকে দোষারোপ না করে বিশ্বব্যাংককে দায়ী করা নিতান্ত উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপানোর শামিল। বিশ্বব্যাংক তো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ঋণ দেয়ার জন্য। তারা চাইবে তাদের ঋণ যতো বেশী সম্ভব বিতরণ করতে। কিন্তু এই ঋণ নিয়ে কোন দেশের ব্যবসায়ীরা যদি ফেরত না দেয়, তা দেখার দায়িত্ব তো সংশ্লিষ্ট দেশেরই। জিয়াউর রহমানের সময় হয়তো কিছুটা ঢালাওভাবে ঋণ প্রদান করা হয়েছে একথা সত্য। কারণ তখন অর্থনীতি ছিলো অত্যন্ত বিকাশমান ও উন্নয়ন কর্ম ছিলো গতিশীল। তিনি ঋণ দিয়ে তো অন্যায় কিছু করেননি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এই ঋণখেলাপীদের নিকট থেকে ঋণ আদায় করা যাদের দায়িত্ব ছিলো তারা তা আদায় করেননি। বরং আশ্রয় প্রশ্রয় তথা ঋণ পুনঃতফশিলিকরণের মাধ্যমে তাদের সীমাহীন সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। এরশাদের আমলে এদের নিকট থেকে ঋণ আদায়ের তেমন কোন চেষ্টা করা হয়নি। বিগত এক যুগেরও বেশী সময় থেকে শুধু খেলাপী ঋণ নয়, পুরো ব্যাংক খাতই চলে গেছে এই দুর্নীতিবাজ ঋণখেলাপীদের হাতে।
এ প্রসঙ্গে ২০২১ সালের ২২ ডিসেম্বর একটি জাতীয় পত্রিকায় বিজয়ের পঞ্চাশ এবং দেশের ব্যাংকিং খাত’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামরিক শাসনামলে বিশেষ করে জিয়াউর রহমানের সময় ‘অর্থ কোন সমস্যা নয়’ (মানি ইজ নো প্রবলেম) শ্লোগানের অধীনে যেসব রাজনৈতিক ঋণ বিতরণ করা হয়েছিলো, তার অধিকাংশই নব্বইয়ের দশকে এসে খেলাপী ঋণে পরিণত হয়। তাছাড়া গত শতাব্দির আশির দশকের মাঝামাঝি দেশের ফিনান্সিয়াল সেক্টর রিফর্ম প্রোগ্রাম হাতে নেয়া হয়। আর এই রিফর্ম প্রোগ্রামের অধীনে সিএল বা ক্লাসিফিকেল অব লোন অর্থাৎ ঋণের শ্রেণী বিন্যাস চালু করা হয়। এই সিএল রিপোর্ট যখন ১৯৯০ এর দশকের প্রথম দিকে তৈরী করা হয়, তখন তা সঠিকভাবে নিরূপণ করা হয়নি।
এছাড়া ২০১৫ সালের ২৯ জুন ‘খেলাপী ঋণ আদায়ে মামলার আহবান সুরঞ্জিতের’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, খেলাপী ঋণ আদায়ে অর্থ আদালতে মামলা করার আহবান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত। জাতীয় সংসদের আসন্ন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের উপর আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি একথা বলেন। মামলা করার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, পত্রিকায় দেখলাম, ৫৯ হাজার কোটি টাকা ঋণ খেলাপী হয়েছে। ৫৫-৫৬ হাজার কোটি টাকা যদি খেলাপী ঋণ হয়, তাহলে আলাপী ঋণ কতো? আলাপী ঋণ মানে যেগুলোর কোন হদিস নেই। হলমার্ক গেলো, সোনালী, রূপালী ব্যাংকের ২২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা গেছে। বেসিক ব্যাংক তো বেসিক হয়ে গেছে। এসব খেলাপী ঋণ আদায় করতে না পারলে বাজেট দিয়ে কী হবে? একই সঙ্গে ব্যাংকিং কমিশন করে আর্থিক খাতে শৃংখলা ফিরিয়ে আনা এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানান তিনি।
প্রশ্ন হচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলের এই বিশিষ্ট নেতা ও অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ানের পরামর্শ কি তার ক্ষমতাসীন দল কখনো আমলে নিয়েছে? এসব বাস্তবায়নের উদ্যোগ বা পদক্ষেপ কি কখনো নেয়া হয়েছে? দেখা গেছে, ঋণ খেলাপীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের দূরে থাক, তাদের বিরুদ্ধে কোন আইনী পদক্ষেপ বন্ধে হাইকোর্টের মাধ্যমে রুল বা আদেশ জারি করা হয়েছে।
এ অবস্থায়, এসবের জোরালো সমালোচনা না করে বা এসব বিষয় এড়িয়ে গিয়ে জিয়াউর রহমানের আমলে ঋণ বিতরণকে দায়ী করা কি ক্ষমতাসীনদের দায়মুক্তির অপকৌশল নয়? আর রেহমান সোবহানের মতো সিনিয়র অর্থনীতিবিদের কাছ থেকে এমন পক্ষপাতদুষ্ট ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য নিতান্তই বেমানান। এমন অভিমত দেশের সচেতন মহলের।