ভয়াবহ বিদ্যুৎ সংকটে দেশ
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ মে ২০২৪, ১২:৩৫:০৯ অপরাহ্ন
বর্তমানে লোডশেডিংসহ যে বিদ্যুৎ সংকট দেখা দিয়েছে এ নিয়ে বছরের শুরুতেই শংকা জেগেছিলো সংশ্লিষ্টদের মাঝে। গত ২৮ জানুয়ারী দেশের একটি শীর্ষ দৈনিকে ‘টাকার অভাব, ডলার সংকটে বিদ্যুৎ জ্বালানীতে বিপুল বকেয়া’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
এতে বলা হয়, দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানী খাত বিপুল পরিমাণ দেনা নিয়ে বিপাকে পড়েছে। একদিকে তারা টাকার অভাবে বেসরকারী বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে বিদ্যুতের দাম যথাসময়ে দিতে পারছে না। অন্যদিকে ডলারের অভাবে বকেয়া রাখতে হচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানী খাতের বিদেশী কোম্পানীগুলোর পাওনা। তথ্য অনুযায়ী, দেশে উৎপাদনরত বেসরকারী বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কাছে পাওনা প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। পিডিবি বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ কর্পোরেশনের (পেট্রোবাংলা) কাছে গ্যাস বিল বকেয়া রেখেছে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। ভারতের আদানির কাছে বিদ্যুতের দাম বকেয়া পড়েছে ৫০ কোটি ডলারের মতো অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা। জ্বালানী তেল আমদানিকারক সরকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) কাছে বিদেশী সরবরাহকারীরা পাবে প্রায় ২৭ কোটি ডলার (প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা)। আর বাংলাদেশে গ্যাস উত্তোলনকারী মার্কিন কোম্পানী শেভরন গ্যাসের দাম বাবদ পাবে ২০ কোটি ডলার (প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা)।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বকেয়া বাড়তে থাকলে জ্বালানী সরবরাহকারীদের আস্থা কমতে থাকে। তারা দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি করতে আগ্রহী হয় না। জ্বালানী সরবরাহে গড়িমসি করে। বকেয়া দিতে দেরী হলে চুক্তি অনুযায়ী জরিমানাও দিতে হয়। ব্যাংকগুলো নতুন আমদানির এলসি বা ঋণপত্র খোলার ফী ও বাড়িয়ে দেয়। লক্ষণীয় যে, জ্বালানীর অভাবে গত বছর গরমে বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রয়োজন অনুযায়ী চালানো সম্ভব হয়নি। ফলে ঢাকায় ২ থেকে ৩ ঘণ্টা এবং গ্রামে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টাও লোডশেডিং করতে হয়েছে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এবার গরমে বিদ্যুৎ সংকট চরমে পৌঁছবে। মিডিয়ার তথ্য অনুসারে, গত সোমবার নজিরবিহীন বিদ্যুৎ ঘাটতির ফলে সাম্প্রতিক সময়ে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের সর্বোচ্চ রেকর্ড গড়েছে। ঐদিন লোডশেডিং পৌঁছে প্রায় ৩২০০ মেগাওয়াটে। বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ঐদিন অর্থাৎ ২৯ এপ্রিল দুপুরে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানী অব বাংলাদেশের ন্যাশনাল লোড ডেসপ্যাচ সেন্টারে রেকর্ড ৩ হাজার ১৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতির কথা জানানো হয়। দিনের পিক আওয়ারে ১৬ হাজার ২০০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন দাঁড়ায় ১২ হাজার ৭৫৩ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ ঘাটতি ৩ হাজার ৪৪৭ মেগাওয়াট। তখন থেকে দেশব্যাপী কমবেশী প্রায় একই ধরনের লোডশেডিং লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, চলমান তাপপ্রবাহে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সারাদেশে লোডশেডিং অব্যাহত। বিশেষভাবে গ্রামীণ এলাকাগুলোতে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি রীতিমতো ভয়াবহ। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পেট্রোবাংলার এক সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রায় ৪ হাজার এমএমসিএফডি চাহিদার বিপরীতে দেশে গ্যাস উৎপাদন হয়েছে ৩ হাজার ১০৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এই গ্যাস সংকটের কারণে বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বিশেষ করে গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। যা এই সংকটের সময়ে বিদ্যুৎ সরবরাহে চাপ বৃদ্ধি করেছে। সম্প্রতি কাতারের আমিরের কাছে এলএনজি’র জন্য ধর্না দিয়েও তেমন কোন ফল হয়নি, এমনটি বলছেন সংশ্লিষ্টরা। পরিস্থিতি যখন এমন তখন ঢাকাদক্ষিণ সিটির মেয়র রাত ৮ টার পর শপিং মল ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসহ দোকানপাট খোলা না রাখার কঠোর নির্দেশ জারি করেছেন। অনেকের আশংকা, বিদ্যুৎ পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটলে দেশের অন্যান্য স্থানেও এমন নির্দেশনা জারি করা হতে পারে।
বলা বাহুল্য, বর্তমান বিদ্যুৎ সংকট ও এর ফলে সৃষ্ট লোডশেডিংয়ের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে চলমান তাপদাহকে দায়ী করা হলেও এই সংকটের শেকড় অনেক গভীরে, যা ইতোমধ্যে বলা হয়েছে। বকেয়া ও ডলার সংকট এর মূল কারণ বলে সচেতন মহলের অভিমত। অনেকের মতে, জনগণ খেয়ে না খেয়ে বিদ্যুতের উচ্চমূল্য নিয়মিত পরিশোধ করলেও এই অর্থ বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতকরণে ব্যয় করা হচ্ছে না। বরং এই অর্থ দেশের বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি যদি সত্য হয়, তবে তা দেশের জন্য অশনি সংকেত। কারণ পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকায় ইতোমধ্যে দেশব্যাপী ব্যবসা বাণিজ্যসহ দৈনন্দিন জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এ অবস্থা বেশীদিন চললে দেশের নাজুক অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়তে পারে, এমন আশংকা তাদের।