এসব কি দায়মুক্তির আইনী প্রক্রিয়া?
প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ মে ২০২৪, ১২:৩০:৪০ অপরাহ্ন
একটি দেশে আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনী নিযুক্ত বা প্রতিষ্ঠিত করা হয় সেই দেশে যাতে কেউ দুর্নীতি, অন্যায়, অবিচার আইন শৃংখলা বিঘœকারী কোন ঘটনা সংঘটন করতে না পারে কিংবা কেউ করলে তাকে দমন করা যায় সেই উদ্দেশ্যে। দুর্নীতি ও অন্যায় প্রতিরোধ করে সর্বোচ্চ আইনানুগ পন্থায় সমাজ ও দেশকে পরিচালিত করাই বিভিন্ন আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তব্য ও দায়িত্ব। কিন্তু বাংলাদেশের এসব আইন শৃংখলা বাহিনীর অনেক উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বেআইনী ও ঘোরতর অন্যায়, অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িত থাকতে দেখা যাচ্ছে।
গতকাল মিডিয়ায় ‘এনএসআই কর্মকর্তার স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবেই শত কোটি টাকা লেনদেন, দুদকের মামলা’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা অধিদপ্তরের (এনএসআই) একজন কর্মকর্তার স্ত্রীর হিসাবে ১৫ বছরে জমা হয় ১২৬ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। একই সময়ে তুলে নেয়া হয় ১২৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা। স্ত্রীর নামে ব্যবসা দেখানো হলেও ব্যাংকিং লেনদেন করেছেন স্বামী। এই এনএসআই কর্মকর্তা হচ্ছেন সংস্থাটির সহকারী পরিচালক আকরাম হোসেন। দুর্নীতি দমন কমিশন অনুসন্ধান চালিয়ে তাদের জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের তথ্য পেয়ে উক্ত কর্মকর্তা ও তার স্ত্রী সুরাইয়া পারভীনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। বর্তমানে এনএসআইয়ের প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত আকরাম হোসেনের নামে ৬ কোটি ৭০ লাখ টাকার বেশী জ্ঞাত আয় বহির্ভুত সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুদক।
এছাড়া একই দিন অপর একটি মিডিয়ায় ‘বিদেশে বেনজীর পরিবারের সম্পদের খোঁজে দুদক’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও তার স্ত্রী সন্তানের নামে বিদেশে কোন সম্পদ আছে কি-না, সেই খোঁজও শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। এর আগে বেনজীর আহমেদের নিজের ও তার স্ত্রী সন্তানদের স্থাবর সম্পদ জব্দ ও ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ (অবরুদ্ধ) করার আদেশ কার্যকর করা শুরু হয়। তার ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে শেয়ার বাজারে থাকা বিও হিসাব ফ্রিজ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে বিএসইসি’কে। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ কোর্টের সংশ্লিষ্ট আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ৫ টি ব্রোকারেজ হাউসে থাকা ৬টি বিও হিসাব পরবর্তী আদেশ না দেয়া পর্যন্ত ফ্রিজ বা অবরুদ্ধ করে রাখার নির্দেশ দেয়া হলো।
জানা গেছে, পুলিশের এই সাবেক আইজি’র নিজের এবং তার স্ত্রী, সন্তান ও কয়েকজন স্বজনের নামে প্রায় শত শত একর জমি রয়েছে। আদালতে পাবলিক প্রসিকিউটর বলেন, বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে নিজ নামে এবং স্ত্রী সন্তানদের নামে দেশে বিেেশ শত শত কোটি টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভুত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। গত বৃহস্পতিবার বেনজীর, তার স্ত্রী ও মেয়ের নামে থাকা স্থাবর অস্থাবর সম্পদ জব্দ (ক্রোক) করার আদেশ দেন ঢাকা মহানগর আদালতের সিনিয়র স্পেশাল জজ। এছাড়া তার সম্পদ কেনার ৮৩ দলিল জব্দ এবং তার স্ত্রী ও মেয়ের নামে থাকা ব্যাংক হিসাবগুলোও ফ্রিজ করতে নির্দেশ দেন আদালত।
এদিকে সাবেক সেনাপ্রধান যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত জেনারেল (অব:) আজিজ আহমেদের দুর্নীতি অনুসন্ধান করতে দুদকে আবেদন করেছেন জনৈক আইনজীবী। গত বুধবার দুদক চেয়ারম্যান বরাবরে করা আবেদনে তিনি বলেন, দুর্নীতির অভিযোগে আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করেছে। অভিযোগ করা হলেও দুদক এ বিষয়ে অনুসন্ধান করেনি। তাই এ বিষয়ে যথাযথ অনুসন্ধানের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো।
বলা বাহুল্য, এদেশে বেশীর ভাগ দুর্নীতির ঘটনা সংঘটন করতে দেখা যায় ক্ষমতাবান প্রভাবশালী এবং বিভিন্ন সরকারী সংস্থার লোকজনকে। সাধারণ মানুষের মাঝে এই অপরাধটি সেই তুলনায় অনেক কম। অবশ্য এই সুযোগও তাদের কম। যেখানে ক্ষমতা ও অর্থ সেখানেই দুর্নীতির ঘটনা বেশী। উপরের কয়েকটি ঘটনা থেকে দেখা যাচ্ছে, যেসব ক্ষমতাধর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এখন দুর্নীতির অনুসন্ধান ও মামলা হচ্ছে, তাদের বেশীর ভাগই অবসরপ্রাপ্ত। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তাদের বিরুদ্ধে কোন তদন্ত কিংবা মামলা বিচারের নজির খুবই কম। ফলে দেশ থেকে দুর্নীতি দূর হচ্ছে না এমনকি নিয়ন্ত্রিতও হচ্ছে না। কোন কোন ক্ষেত্রে আদালতকে দুর্নীতির তদন্তের নির্দেশ দিলেও অনেক বড় বড় ঘটনায় আদালত উল্টো তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত স্থগিত বা বন্ধ রাখার নির্দেশ দিতে দেখা যাচ্ছে। এটা বিচার বিভাগের বৈষম্যমূলক দু’মুখী নীতি।
ক্ষমতার শীর্ষ মহলের চাপে তারা এমনটি করছেন, এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্ট মহলের। যা-ই হোক, বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারী সংস্থা অন্যায়, দুর্নীতি ও অপরাধ দমনের দায়িত্বে নিয়োজিতদের এভাবে ব্যাপক হারে দুর্নীতিতে জড়িত হওয়ার বিষয়টি দেশের আইন শৃংখলা ও নৈতিকতার জন্য অশনি সংকেত স্বরূপ। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে এ ধরনের আইনী পদক্ষেপ নেয়া হলে এদেশে দুর্নীতি ও অপরাধ অপকর্ম যে বহুলাংশে হ্রাস পাবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। আবার এ ধরনের আইনী পদক্ষেপ ও বিচার যেনো আইওয়াশ না হয় সেদিকেও দৃষ্টি রাখতে হবে। অন্যথায় দায়সারা জেল জরিমানা দিয়ে দুর্নীতি সংঘটনকারী বড় বড় অপরাধীকে দায়মুক্তির ব্যবস্থা হতে পারে কুচক্রী ও স্বার্থান্বেষী মহলের যোগসাজশে।