গবেষণায় পিছিয়ে কেন বাংলাদেশ?
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ জুন ২০২৪, ১২:৩৫:২৬ অপরাহ্ন
সম্প্রতি মিডিয়ায় ‘গবেষণা ব্যয় তলানিতে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে গবেষণা ও মান উন্নয়নে খরচ বাড়াতে অর্থনীতিবিদ ও গবেষকরা প্রতিনিয়ত বলে যাচ্ছেন। সরকার বিভিন্ন সময়ে এ বিষয়ে ইতিবাচক আশ^াসও দিয়েছে। তবে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলেছে, দেশের জিডিপির তুলনায় মাথা পিছু গবেষণা ব্যয় এখনো অনেকটা তলানিতে রয়েছে বিবিএসের হিসাবে। দেশে গবেষণা ও মান উন্নয়ন কার্যক্রমে বছরে মাথাপিছু আনুমানিক ব্যয় (জিআইআরডি) প্রায় ৬২০ টাকার। মোট দেশজ উৎপাদনের তুলানায় এই ব্যয় মাত্র শূন্য দশমিক ৩০ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের ভবিষ্যত অর্থনৈতিক চাহিদার কথা চিন্তা করেই গবেষণা ও উন্নয়নে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। তা না হলে অন্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আমরা অনেক পিছিয়ে থাকবো।
জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি ১০ লাখ মানুষের বিপরীতে গবেষক আছেন ১০৭ জন। ২০২০-২১ অর্থ বছরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মোট গবেষক ছিলেন ১৮ হাজার ২৫ জন। সিপিডি’র সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে এখন উদ্ভাবন, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির সময়। কিন্তু বরাদ্দ কম থাকলে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকবে। বিশেষ করে মৌলিক গবেষণার পরিধি বাড়াতে সরকারকে নিজ দায়িত্বে এগিয়ে আসতে হবে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, দেশে সরকারি বেসরকারি ১৫০টি বিশ^বিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৫টি ২০২০ সালে গবেষণা খাতে একটি টাকাও ব্যয় করেনি। মাত্র ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেছে ৪৪টি বিশ^বিদ্যালয়। এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, একাধিক পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ে সারা বছরে দু’চারটি প্রকাশনা ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোন গবেষণা কর্ম সম্পাদিত হয়নি।
বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে আর্থিক প্রণোদনা অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন বা জাপানের মতো বরাদ্দ দেয়া সম্ভব না হলেও যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা হয়, সেটিও যদি সঠিক পথে এবং উপযুক্ত গবেষকদের দ্বারা সম্পন্ন করা হতো, তবে গবেষণায় বাংলাদেশ এতোটা পিছিয়ে থাকতো না। বাংলাদেশে অনেক ভালো ভালো অধ্যাপক-গবেষক রয়েছেন, যারা আর্থিক প্রণোদনা, মূল্যায়ন এবং নিরাপত্তা বা স্বাধীনতার অভাবে গবেষণায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। অথচ বর্তমান প্রজন্মকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে গবেষণায় কোন বিকল্প নেই। গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান ও ধরণার জন্ম হবে, সমাজে বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য গবেষণালব্দ সমাধান আসবে। যে কোন পরিস্থিতিতে টিকে থাকার কৌশল গবেষণা ফলাফলের উপর নির্ভল করে নির্নীত হবে। কী বা কেমন পরিস্থিতি দেশ ও বিশ^বাসীকে সামনে মোকাবেলা করতে হবে, তা-ও উদঘাটিত হবে গবেষণার মাধ্যমে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ। সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যর্থ হলে বিশ^বাজারে টিকে থাকা দায় হয়ে পড়বে বাংলাদেশের মতো গবেষণা বিমুখ দেশের।
লক্ষণীয় যে, বাংলাদেশে পরিকল্পনা বা গবেষণার স্বরূপ বোঝা যায় উন্নয়নমূলক কর্মকা- ও পরিণতি দেখে। এ ক্ষেত্রে কিছু উদাহরণ দেয়া যাক। দেশের একটি নগরীর মাঝখানে একটি বিশাল ফ্লাইওভার তৈরির কাজ চলছে প্রায় বছর খানেক সময় ধরে। এতে নগরবাসীর কী কষ্ট তা ভাবার ফুরসৎ নেই কর্তৃপক্ষের, সেটা মানতে নগরবাসী বাধ্য, যেহেতু বাংলাদেশের জন্য তা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু কিছু দিন পর কাজ চলাকালীন দেখা গেলো ফ্লাইওভারের পরিকল্পনায় বড়ো ধরণের পরিবর্তন আনা হয়েছে। রেললাইন স্থাপন করা হলো কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে। কিন্তু কয়েক বছর পর দেখা গেলো এটার কোন কাজ বা উপযোগিতা নেই। এখানে আরো সুপরিসর লাইন দরকার। ফলে তুলে ফেলা হলো রেললাইন। পানিতে গেলো কয়েক হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশে গবেষণা ও পরিকল্পনা ক্ষেত্রে বিরাট ঘাটতির কারণে উন্নয়নের ক্ষেত্রেই যে পিছিয়ে পড়ছে এমন নয়, প্রচুর অর্থের অপচয় হচ্ছে এ জন্য প্রতি বছর। যথেষ্ট গবেষণার পর পরিকল্পিতভাবে কোন উন্নয়ন কাজ করা হলে এমন বিপত্তি ঘটার কথা নয়। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা দেশে গবেষণা ক্ষেত্রে ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধির ওপর জোর দিচ্ছেন। বিশেষভাবে দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য তাগিদ দিচ্ছেন। এসব বিশ^বিদ্যালয়ে গবেষণার পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকায় এবং ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জনের সুযোগ সীমিত হওয়ায় দেশের মেধাবী শিক্ষার্থী এমনকি শিক্ষকরা ও বিদেশমুখী হতে বাধ্য হচ্ছেন। এটা দেশের ভবিষ্যত উন্নয়ন ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে অশনি সংকেত স্বরূপ। বিষয়টি নিয়ে এখনি ভাবনা চিন্তা করা দরকার।