ব্যাংক থেকে ‘বিশ্বাস’ চুরি!
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ জুন ২০২৪, ১২:৩৫:২১ অপরাহ্ন
অর্থ কিংবা লকারে গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান কিছু রাখার জন্য মানুষ সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য স্থান মনে করে ব্যাংককে। কিন্তু এই ব্যাংকই যখন গ্রাহকের অর্থ বা লকারে রক্ষিত সামগ্রীর নিরাপত্তা বিধানে ব্যর্থ হয়, তখন আর যাওয়ার মতো তেমন কোন আস্থার জায়গা থাকে না। বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংক মানুষ তথা গ্রাহকদের সেই আস্থা ও নির্ভরতার স্থান থেকে ক্রমশঃ দূরে যাচ্ছে, হয়ে ওঠছে আরো দশ পাঁচটি নিরাপত্তাহীন সাধারণ জায়গার মতো। ব্যাংক খাতের অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। কখনো ব্যাংক ম্যানেজার কর্তৃক গ্রাহকের টাকা নিয়ে উধাও হওয়া, আবার কখনো অনিয়মতান্ত্রিক পন্থায় জাল কাগজপত্র দিয়ে ব্যাংক ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করা ইত্যাদি।
সম্প্রতি ব্যাংকের লকার থেকে জনৈক গ্রাহকের বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ খোয়া যাওয়ার ঘটনা ব্যাংক খাতের নাজুক সুনাম ও আস্থা নির্ভরতার বিষয়টিকে রীতিমতো প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সম্প্রতি চট্টগ্রামে ইসলামী ব্যাংক চকবাজার শাখার লকার থেকে গ্রাহকের এক কোটি ৭৪ লাখ টাকা মূল্যের ১৪৯ ভরি সোনা গায়েবের ঘটনায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। এতে অনেকেই হয়েছেন অবাক। কারণ এক সময় এই ইসলামী ব্যাংকের সুনাম ছিলো আকাশচুম্বী। এ নিয়ে ব্যাংকটির শীর্ষ কর্মকর্তার দাবি উক্ত গ্রাহক মিথ্যা অভিযোগ করছেন। ইতোমধ্যে গ্রাহক রোকেয়া আক্তার বারী বাদী হয়ে গত ৩ জুন তারিখে চকবাজার থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। অভিযোগে ইসলামী ব্যাংকের ৪ কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। অভিযুক্তরা হলেন ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরুল মাওলা, কোম্পানী সেক্রেটারী জে কিউ এম হাবিব উল্লাহ, চকবাজার শাখার ব্যবস্থাপক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম শফিকুল মাওলা চৌধুরী ও লকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ ইউনুস।
চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, ইসলামী ব্যাংক চকবাজার থেকে ১৪৯ ভরি স্বর্ণ চুরি হওয়ার ঘটনায় অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী নারী গ্রাহক। তবে অভিযোগপত্রের সব আসামী ব্যাংক কর্মকর্তা। এই অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনের দুদক (শিডিউলভুক্ত)। এ কারণে বাদীর অভিযোগ থানায় জিডি হিসেবে গ্রহণ করে দুদকে পাঠিয়ে দেয়া হবে।
অভিযোগপত্রে রোকেয়া আক্তার বারি উল্লেখ করেন, ২০০৬ সাল থেকে ইসলামী ব্যাংক চকবাজার শাখায় আমি ও আমার মেয়ে নাসরিন মারজুবা যৌথভাবে একটি লকার ব্যবহার করে আসছি। লকারে আমার ও আমার মেয়েসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যের ১৬০ ভরি স্বর্ণালংকার ছিলো। গত ২৯ মে দুপুর দেড়টায় আমার কিছু স্বর্ণালংকার আনার জন্য ব্যাংকে যাই। লকারের দায়িত্বরত অফিসার ইউনুসকে আমার লকার খুলে দেয়ার জন্য অনুরোধ করি। তিনি লকার কক্ষের দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংক অফিসার আমার নামে বরাদ্দকৃত লকারটি খোলা দেখতে পান। আমাকে বললে আমি হতভম্ব হয়ে পড়ি।
এ ব্যাপারে ব্যাংক ম্যানেজারের বক্তব্য হচ্ছে, উক্ত গ্রাহক মিথ্যা বলছেন। হ্যাঁ, তিনি তা বলতে পারেন। কারণ উনার লকারে উনি কি রাখছেন না রাখছেন তা উনি নিজে জানেন। আর লকারে কিছু রাখলে বা এখান থেকে কিছু নিয়ে গেলে এর কোন লিখিত রেকর্ডও থাকছে না। অপরদিকে সিসিটিভিসহ অন্যান্য সকল নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেদ করে এখান থেকে অর্থাৎ ব্যাংকের অভ্যন্তরে রক্ষিত নিরাপদ লকার থেকে কেউ কিছু নিয়ে গেলে সেটা দেখার বা খেয়াল রাখার দায়িত্ব ব্যাংক কর্তৃপক্ষের। প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, সেই দায়িত্ব তারা যথাযথভাবে পালন করছেন কি-না। এটা স্পষ্ট যে, বাইরে থেকে কোন চোর কিংবা ডাকাত বা ডাকাত দল এসে এটা করেনি। কারণ সেক্ষেত্রে প্রমাণ থাকতো। গেট ও লকার রুমসহ অন্যান্য নিরাপত্তা বেষ্টনী ভাঙ্গার আলামত থাকতো।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বিনা বাধায় কেউ একজন বা কয়েকজন ব্যাংকে ঢুকে বিকল্প চাবি দিয়ে লকার খুলে স্বর্ণালংকার নিয়ে গেছে এবং কিছু রেখে গেছে। বাইরের চোর বা ডাকাত হলে ১০ ভরি স্বর্ণ রেখে যাবার কথা নয়। ব্যাংক ম্যানেজারের কথা যদি সত্যি হয় অর্থাৎ ৬০ বছর বয়সী একজন প্রয়াত চিকিৎসক পতœী এই নারী গ্রাহক যদি মিথ্যা বলে থাকেন তবে তা প্রমাণ করা কঠিন। তবে সাধারণ বিবেকবোধ থেকে ধারণা করা যায়, যখন একটি পরিবারের একজন বয়োবৃদ্ধ অভিভাবক পুরুষ বা নারী যখন তাদের সন্তানদের জন্য জীবনের সবকিছু উজাড় করে দেন, তখন নিজের পরিবারের সদস্যদের স্বর্ণ আত্মসাত বা সরানোর ঘটনা বিশ্বাস করা কঠিন। অপরদিকে এ ঘটনায় লকারসহ ব্যাংকের দায়িত্বপ্রাপ্তদের দিকে যে কারো অভিযোগের আঙ্গুল সহজেই ওঠতে পারে এজন্য যে, দেশের ব্যাংক খাত এখন চরম দুর্নীতিগ্রস্ত ও অনির্ভরযোগ্য স্থানে পরিণত হয়েছে। মামলায় গ্রাহক তার প্রায় কোটি টাকার খোয়া যাওয়া স্বর্ণালংকার ফিরে পাবেন, এমন প্রত্যাশা দুরাশা বলেই মনে হয়। তবে এ ঘটনায় সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যাংক খাত। ব্যাংক খাতের উন্নতি ও অগ্রগতির পূর্বশর্ত হচ্ছে গ্রাহকের আস্থা ও তার অর্থসম্পদের নিরাপত্তাবোধ। আর এ ঘটনায় যে এটাই বহুলাংশে ভেঙ্গেচুরে ধুলোয় মিশে গেছে, এতে কোন সন্দেহ নেই।