হায়রে স্বাস্থ্যখাত!
প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ জুন ২০২৪, ১২:৩৫:০৫ অপরাহ্ন
গতকাল একটি জাতীয় মিডিয়ায় ‘কমছে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ, বেশী ব্যয়েও ভোগান্তি বাড়ছে মানুষের’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্যখাতে বাংলাদেশের মানুষের ব্যয় ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ব্যক্তি পর্যায় থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত কোন জায়গাতেই স্বাস্থ্যখাত সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় নেই। সরকার এদিকে যথাযথ মনোযোগ দেয় না। ফলে এই খাতে মানুষের ব্যয় বাড়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতির অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, স্বাস্থ্য নিয়ে অবহেলার কারণেই মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে এবং হাসপাতালে রোগীদের চাপ বাড়ছে। সরকারী হাসপাতালগুলো এতো বেশী রোগীকে সেবা দিতে পারে না। যার কারণে রোগীরা বেসরকারী হাসপাতালে যেতে বাধ্য হয়। অনেক ক্ষেত্রে তারা বেসরকারী হাসপাতালেও প্রত্যাশিত সেবা পায় না। তিনি আরো বলেন, এর চেয়ে বড়ো ক্ষতি হচ্ছে, বাংলাদেশ একটি অস্বাস্থ্যকর জাতিতে পরিণত হচ্ছে এবং চিকিৎসা সেবার নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ বেরিয়ে যাচ্ছে দেশ থেকে।
দেখা যাচ্ছে, মানুষ ওষুধ কিনতে অনেক বেশী টাকা ব্যয় করছে এবং ধনীরা দরিদ্রদের তুলনায় বেশী অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে এজন্য। এ কারণেই বাংলাদেশে এই খাতে বেশী ব্যয় করতে হচ্ছে জনগণকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুসারে, বাংলাদেশের মতো দেশে স্বাস্থ্যখাতে জিডিপি’র অন্তত: ৫ শতাংশ বরাদ্দ থাকতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে এই খাতে সাধারণত: বরাদ্দ দেয়া হয় মাত্র ১ শতাংশ। প্রতি বছর স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়ে। কিন্তু সেটা হয় জাতীয় বাজেটের আকার বাড়ার কারণে। স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দের সিংহভাগই ব্যয় হয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের বেতন ও অন্যান্য ব্যয়ের জন্য। এছাড়া ভুল অগ্রাধিকার নির্ধারণ, অনিয়ম ও অদক্ষতার কারণে স্বাস্থ্যসেবা বাজেটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অভিষ্ঠ নাগরিকদের কাছে পৌঁছে না। বিদ্যমান স্বাস্থ্য অবকাঠামো থেকে মানুষ যে সেবা পাওয়ার কথা তা পাচ্ছে না। ওষুধ ও মেডিকেল টেস্টে খরচ নিয়ন্ত্রণ না থাকায় ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।
লক্ষণীয় যে, বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর প্রথম বছরে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করে প্রায় ৫ হাজার ১০৪ কোটি টাকা। যদিও এই পরিমাণ ছিলো ২০০৯-১০ অর্থ বছরের জাতীয় বাজেটের মোট ব্যয়ের মাত্র ৬ শতাংশ। এরপর গত ১৫ বছরে স্বাস্থ্যখাতে অবকাঠামো, চিকিৎসক ও রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্যখাতে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। কিন্তু অন্যতম মূল এই খাতে সরকারের প্রকৃত ব্যয় স্থবির এবং কিছু অর্থ বছরে এটি বরং কমেছে। যেমন, ২০২১-২২ অর্থ বছরে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হয়েছে ২৫ হাজার ২৮ কোটি টাকা বা মোট ব্যয় ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকার মাত্র ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এর আগের অর্থ বছরে সরকার মোট ব্যয় করেছে ৪ লাখ ৬০ হাজার ১৬০ কোটি টাকা, যেখানে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় হয়েছে ৫ শতাংশ বা ২১ হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা। স্বাস্থ্যখাতে বাংলাদেশের এই হতাশাজনক ব্যয় বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সর্বনি¤œ। এর ফলেই দরিদ্র ও স্বল্প আরে মানুষকেও স্বাস্থ্যখাতে উচ্চ ব্যয় বহন করতে হচ্ছে। ২০২০ সালে বাংলাদেশের মানুষকে তাদের চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশ নিজেদের বহন করতে হয়েছে। এই তালিকায় বাংলাদেশের উপরে আছে শুধুমাত্র আফগানিস্তান-দেশটির নাগরিকদের ৭৮ শতাংশ ব্যয় নিজেদের বহন করতে হয়।
সর্বোপরি বাংলাদেশে সরকারী চিকিৎসা সেবার অপর্যাপ্ততা ও নাজুক অবস্থা সাধারণ মানুষকে বেসরকারী চিকিৎসা সেবা গ্রহণে বাধ্য করছে। আর এই সুযোগ নিচ্ছে বিভিন্ন বেসরকারী চিকিৎসা সেবা খাত। ওষুধ কোম্পানীগুলো সরকারী নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে কিংবা কর্তৃপক্ষের অসৎ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ওষুধের দাম ক্রমাগত বৃদ্ধি করছে। এক্ষেত্রে সরকারের যেমন কোন নিয়ন্ত্রণ নেই তেমনি নিয়ন্ত্রণের কোন সদিচ্ছাও নেই। চিকিৎসকরা ইচ্ছে খুশীমতো ফী আদায় করছেন। ৫/১০ মিনিট রোগীর পেছনে ব্যয় করে অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হাজার-দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত ফী নিচ্ছেন। অনেক চিকিৎসক ওষুধ কোম্পানীর উপঢৌকন, উৎকোচের বশবর্তী হয়ে বিনা প্রয়োজনে অনেকগুলো ওষুধ প্রেসক্রাইব করছেন। কমিশনের আশায় বিনা প্রয়োজনে হরেক রকম টেস্টের পরামর্শ দিচ্ছেন। এভাবে দেশের সাধারণ সীমিত আয়ের মানুষ অসুস্থ হলে এক অসহনীয় দুর্বিষহ অবস্থার মতো নিপতিত হচ্ছেন। এ অবস্থায় সরকারী স্বাস্থ্যখাত তাদের তেমন কোন সহায়তা করতে পারছে না বা করছে না। কারণ স্বাস্থ্য সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় নেই। চিকিৎসা একটি দেশের জনগণের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে শীর্ষে থাকলেও বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম। এ অবস্থায় জনগণ চিকিৎসার জন্য বিদেশমুখী হচ্ছেন, ফলে দেশ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। বৈদেশিক মুদ্রা তথা ডলার সংকটের সময়ে যা রীতিমতো হৃদয়বিদারক।