কোন পথে রাজনীতি?
প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ এপ্রিল ২০২৫, ১২:১০:৪৪ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় দেশে এবার উদযাপিত হলো ঈদুল ফিতর। গত সপ্তাহজুড়েই ছিলো ঈদের আমেজ। তবে আজ থেকে আবার কর্মমুখর হয়ে উঠবে দেশ। ঈদের শেষে তাই সামনে আসছে ‘কোন পথে দেশের রাজনীতি’। সাম্প্রতিক কয়েক সপ্তাহের রাজনীতির প্রধান আলোচ্য বিষয় দেশে আগামী নির্বাচনের দিন-তারিখ কবে ঘোষণা হবে। রোজার মধ্যে নানাভাবে নিজেদের উপস্থিতি জারি রাখার চেষ্টা করেছে রাজনৈতিক দলগুলো।
ঈদের শেষে বিএনপি, জামায়াতসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীরা নিজ নিজ এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন। পিছিয়ে নেই সদ্য গঠিত দল এনসিপিও। তবে মজার ব্যাপার হলো এবার মাঠে কোনো ‘সরকারি দল’ নেই। আওয়ামীলীগও রাজনীতির মাঠে অদৃশ্য, পালিয়ে বেড়াচ্ছেন নেতা-কর্মীরা। তাই রাজনীতির মাঠ সরগরম হচ্ছে নতুন এক আবহে, ভিন্ন এক মাত্রায়। এদিকে, ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর সময় যতই গড়িয়েছে, অভ্যুত্থানের পক্ষগুলোর মধ্যে ততই বিভিন্ন ইস্যুতে মতভেদ স্পষ্ট হচ্ছে। মতভেদ এখন এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, রমজান মাসজুড়ে ইফতার পার্টিগুলোতে বিভিন্ন দলের নেতাদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিতে দেখা গেছে।
অবশ্যপাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিতে দেখা গেলেও বেশ কয়েক বছর পরে এবারই আবার একে অন্যকে ইফতার আয়োজনে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বিভিন্ন দলের নেতারা এবং তারা নিজেরাও অংশও নিয়েছেন অন্য দলের ইফতারে। এখন ঈদের পর দেশের রাজনীতিতে নির্বাচন এবং সংস্কার ইস্যুতে দলগুলোর মতভেদ বড় আকারে সামনে চলে আসতে পারে এমন ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।
রাজনীতি সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, চলতি মাসেই কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামছে বিএনপি। সংসদ নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে এ মাস থেকে শুরু হবে তাদের নানা কর্মসূচি। ধীরে ধীরে এ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইছে তারা। এর আগে সরকারের কাছে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরতে আগামী সপ্তাহে আবারও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করবেন বিএনপি নেতারা। সেখানে নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানানো হবে। এছাড়া ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে রোডম্যাপ ঘোষণার দাবিও জানানো হবে। এছাড়া দলভেদে কোনো কর্মসূচি আসবে কি না, তা নিয়েও রাজনীতির অঙ্গনে আলোচনা রয়েছে। যদিও বিমসটেক সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা দ্রুত নির্বাচনের স্পষ্ট অঙ্গীকার করেছেন।
বিএনপি নির্বাচনে জোর দিলেও জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি জোর দিয়ে এসেছে রাষ্ট্রীয় সংস্কার এবং জুলাই আগস্টে নিপীড়নের দায়ে আওয়ামী লীগের বিচারে দাবিতে। অগ্রাধিকারের দিক থেকে এগুলোর পরে নির্বাচনকে রেখেছে তারা।
অন্যদিকে, বিএনপি’র কর্মসূচিগুলোতে দ্রুত একটি জাতীয় নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা আলোচিত হয়েছে বার বার। সম্প্রতি স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, নির্বাচনের ব্যাপারে আমি আগেও বলেছি, আবারও বলছি, এ বছর ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। রাজনৈতিক দলগুলো ‘নির্বাচনের জন্য তৈরি হতে শুরু করবে’ বলেও আশা প্রকাশ করেন প্রধান উপদেষ্টা। তবুও কেন বিএনপি নির্বাচনের চাপ দিচ্ছে- এ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বেশি।
গত ডিসেম্বর থেকেই বিভিন্ন সময়ে নির্বাচনের তারিখ নিয়ে ‘ধোঁয়াশা’ ও ‘অস্পষ্টতার’ অভিযোগ তুলে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দেয়ার দাবি জানিয়ে আসছে দলটি। এবার এ দাবিতে তারা আরো সক্রিয় হতে চায়। আরো একবার আনুষ্ঠানিকভাবে তাগাদা দিতে চায় সরকারকে।
ঈদের পর প্রধান উপদেষ্টার সাথে দেখা করে বিএনপি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার আহ্বান জানাবে, বলেছেন দলটির নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমদ। নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে ‘অস্পষ্টতা’কে বিএনপি দেখছে সন্দেহ ও সংশয় নিয়ে। নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা না করার পেছনে কারণ কী, সেটি বুঝতে চায় তারা।
অন্যদিকে, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের আরেক অংশীদার বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন প্রসঙ্গে সরকারের অবস্থানের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করছে। দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বিবিসিকে বলেছেন, অধ্যাপক ইউনূসের বক্তব্যে পূর্ণ আস্থা রাখছে তার দল।
মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, এমন না যে সরকার কিছুই বলেনি। সরকার তো একটা আইডিয়া দিয়েছে। সরকার গ্রহণযোগ্য যতটুকু সময় চাচ্ছে, জামায়াতে ইসলামী ততটুকু সময় দেয়ার পক্ষে। ৬ মাস আগে কী পরে – এটা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। ন্যূনতম সংস্কার ছাড়া তাড়াহুড়ো করে নির্বাচন করে চৌদ্দ-আঠারোর মত নির্বাচন হলে লাভ কী? তাই সময়কে শর্ত না বানিয়ে আমরা নিরপেক্ষ নির্বাচনকে শর্ত বানিয়েছি।
সংস্কার ও নির্বাচনের প্রক্রিয়া একসঙ্গে চলতে পারে সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিবের এমন মন্তব্যের উল্লেখ করে এর সাথে দ্বিমত পোষণ করেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল। তিনি বলেন, একদিকে বলবো সংস্কার চাই, অন্যদিকে বলবো সংস্কার ও নির্বাচন একসাথে হয়। হয় না। তাহলে পেছনের ১৫ বছরের কালো জীবন আমাদের ফিরে আসবে। তিনি বলেন, তারা (জামায়াত) আপাতত মাঠে নামার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন না। অন্য কোনো রাজনৈতিক দল যদি নির্বাচনের সময়ের জন্য আন্দোলনে নামে, তারা কী বলে সেটা দেখে তখন আমাদের দলের বক্তব্য তুলে ধরা হবে।
আগামীতে সরকারকে নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে সহযোগিতা ও নির্বাচনমুখী রাজনীতি করার কথা বলেন জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের এই নেতা। অন্যদিকে, রাষ্ট্রের সামগ্রিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে সক্রিয় থাকতে চায় গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারীদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপি।
নতুন দলটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, আমরা জনগণের কাছে রাষ্ট্রের সংস্কারের প্রক্রিয়ার প্রয়োজনীয়তা হাজির করবো। দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে রাষ্ট্রের সামগ্রিক সংস্কারে সরকারের উদ্যোগকে দৃশ্যমান করা, গণহত্যার অপরাধে আওয়ামী লীগের বিচার কার্যক্রমকে গতিশীল করা ও গণপরিষদ নির্বাচনের দিকে সরকারের পদক্ষেপ গ্রহণ করার বিষয়ে আমরা রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবো।
বিএনপি এবং এনসিপি ভিন্ন ভিন্ন অগ্রাধিকার নিয়ে মাঠে থাকলে রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়াতে পারে কী না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা মনে করি পূর্বের মতো হানাহানি-মারামারির যে রাজনীতি ছিল, তার বাইরে এসে পলিসি নির্ধারণের যে রাজনীতি, রাজনৈতিক দলগুলোকে সেইদিকেই এগোনো উচিত।
এদিকে, ক্রমশ বৈরিতার পথে হাঁটা দলগুলোর অবস্থান আগামীতে তৃণমূলের রাজনীতিতে কিছুটা উত্তেজনা ছড়াতে পারে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ। তিনি বলেন, বিশেষ করে এই ধারণা ছড়াতে পারে যে, সরকার এনসিপিকে আরেকটু স্ট্রং ফুটিং (পরিধি বাড়ানোর) এর সুযোগ করে দিচ্ছে। তবে সার্বিক পরিস্থিতি থেকে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে, বিএনপি’র প্রত্যাশামত ডিসেম্বরে নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারণ, ন্যূনতম সংস্কার এবং ঐকমত্যে পৌঁছানোর চ্যালেঞ্জ উতরানো সহজ হবে না। ফলে বিএনপি একটা চাপ ধরে রাখতে চাইবেই।