মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা প্রসঙ্গে
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০১:৪৬ অপরাহ্ন
জানা গেছে, মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা প্রণয়ন করছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। পরিবহন বিভাগের যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে ৯ সদস্যের কমিটি ইতোমধ্যে তৈরী করেছে ‘মোটরসাইকেল চলাচল নীতিমালা-২০২৩’ এর খসড়া। এতে বলা হয়েছে যে, রাজধানীতে মোটর সাইকেল ৩০ কিলোমিটারের বেশী গতিতে চালানো যাবে না। ঈদ ও উৎসবের সময় মহাসড়কে চলাচল করতে পারবে না মোটরসাইকেল।
অনেকের মতে, রাজধানীতে মোটরসাইকেলের গতি ৩০ কিলোমিটার নির্ধারিত হলে, অন্যান্য দ্রুতগতির যানবাহনের সঙ্গে একই লেনে চললে দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরো বাড়বে। গতিসীমা নির্ণয় প্রসঙ্গে কর্তৃপক্ষের বক্তব্য হচ্ছে, পুলিশের কাছে গতি নির্ধারণের যন্ত্র থাকবে। গতিসীমা লংঘনের শাস্তি সড়ক পরিবহন আইনে নির্ধারণ করা আছে। কর্তৃপক্ষের মতে, খসড়া নীতিমালায় মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ নয়, গতি কমানোর দিকে জোর দেয়া হয়েছে। মোটরসাইকেলে বয়স্ক ও শিশুকে আরোহী না করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বিএসটিআই অনুমোদিত উন্নতমানের হেলমেটসহ অন্যান্য নিরাপত্তা সরঞ্জাম চালককে ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে এতে। সড়ক যানবাহনভেদে গতি নির্ধারণ করা হবে চূড়ান্ত নীতিমালায়।
লক্ষণীয় যে, যাত্রী কল্যাণ সমিতি ও রোড সেইফটি ফাউন্ডেশনসহ বেসরকারী সংস্থাগুলো সড়ক দুর্ঘটনার যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে, সে অনুযায়ী সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির প্রায় ৪০ শতাংশের সঙ্গে মোটরসাইকেলের সংশ্লিষ্টতা লক্ষ্য করা গেছে। সারাদেশে নিবন্ধিত ৫৬ লাখ ২৮ হাজার যানবাহনের মধ্যে ৪০ লাখ ৩৯ হাজারই হচ্ছে মোটরসাইকেল। গত ১১ বছরে সারাদেশে ৪ গুণ হয়েছে মোটরসাইকেলের সংখ্যা। ২০২২ সালে নতুন ৫ লাখ ৬ হাজার ৯১২ টি মোটরসাইকেল নিবন্ধিত হয়েছে। তবে রাজধানীতে মোটরসাইকেল বাড়ার হার আরো বেশী। ঢাকায় গত ১১ বছরে ৫ গুণ হয়েছে এই দ্বিচক্রযানের সংখ্যা। ঢাকায় নিবন্ধিত ১৯ লাখ ৬৫ হাজার যানবাহনের মধ্যে ১০ লাখ ২৩ হাজারই মোটরসাইকেল। গত জুনে সওজ মহাসড়কে মোটরসাইকেল নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করেছিলো। প্রস্তাবটি সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের সভায় ওঠলেও সরকারের অনুমোদন পায়নি। সড়ক পরিবহন বিভাগের মতে, মোটরসাইকেল উভয়সংকট তৈরী করেছে। বিদেশী নামীদামী কোম্পানী বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে কারখানা তৈরী করে মোটরসাইকেল উৎপাদন করছে। বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে সরকার তাদের কর ছাড় দিয়েছে। এতে মোটরসাইকেলের দাম কমেছে। সড়কে মোটরসাইকেলের সংখ্যা বাড়ছে। মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ করলে বিদেশী বিনিয়োগের সুরক্ষা নিয়ে প্রশ্ন ওঠবে। এ নিয়েও সংশ্লিষ্টরা উদ্বিগ্ন।
বলা বাহুল্য, মোটরসাইকেল নামক ক্ষুদ্র দ্বিচক্রযানটি যে এদেশের সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধির পেছনে বিশেষভাবে দায়ী এতে কোন সন্দেহ নেই। প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত ও পরিসংখ্যানই এর প্রমাণ। কিন্তু মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার মূল কারণ ও তা দুরীকরণ নিয়ে সরকারের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ একপেশে ধ্যান ধারণা পোষণ করছেন, এমন অভিমত সচেতন মহলের। কর্তৃপক্ষসমূহ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার জন্য মোটরসাইকেলের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং চালক ও আরোহীদের হেলমেট পরিধানসহ অন্যান্য নিয়মনীতি না মানা এবং দ্রুতগতির বিষয়কে বিশেষভাবে দায়ী করছেন। কিন্তু মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার সবচেয়ে বড় কারণ মোটরসাইকেলের মতো ক্ষুদ্র যানবাহনের জন্য সড়কে আলাদা লেইন না থাকার বিষয়ে তেমন গুরুত্বপূর্ণ দিচ্ছেন না। গুরুত্ব দিচ্ছেন না দেশে একটি সুষ্ঠু ও পরিকল্পিত সড়ক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার বিষয়ে। শুধুমাত্র সুষ্ঠু সড়ক নেটওয়ার্ক ও কঠোর ট্রাফিক আইনের কারণে বিশ্বের সবক’টি উন্নত দেশ এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশেও বাংলাদেশের চেয়ে কয়েকগুণ বেশী যান্ত্রিক যানবাহন চলাচল সত্বেও দুর্ঘটনার হার অনেক কম। ঐসব দেশে মোটরসাইকেল ও অন্যান্য ক্ষুদ্র যানবাহনের জন্য আলাদা লেইন ও গতিসীমা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সবাই কঠোর ও নিয়মনিষ্ঠার সাথে ট্রাফিক আইন মেনে চলে। তাই সুষ্ঠু ও সড়ক নেটওয়ার্ক না গড়ে এবং ট্রাফিক আইনের যথাযথ প্রয়োগ না করে মোটরসাইকেল বা অন্যান্য যানবাহনের সংখ্যা ও গতি নিয়ন্ত্রণ করলেই দুর্ঘটনা কমে যাবে, এমন ধারণা অবান্তর ও অযৌক্তিক।
রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন শহর ও নগরে এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলে মোটরসাইকেলের সংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে অনেকগুলো কারণ বিদ্যমান। এদেশের অধিকাংশ রাস্তাঘাট ও গলিপথের সংকীর্ণতা, জরাজীর্ণ দশা চার-চাকার যানবাহনের জন্য যতোটা অনুপযোগী, ততোটা সহজ ও উপযোগী মোটরসাইকেলের মতো ক্ষুদ্র যানবাহনের জন্য। এছাড়া জ্বালানীর মূল্যবৃদ্ধির ফলে বড় যানবাহন চালানো এখন ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। সেই তুলনায় মোটরসাইকেলে জ্বালানীর খরচ অনেক কম। এছাড়া শেয়ার রাইডিং ব্যবসা চালু হওয়ায় তুলনামূলক অল্প ভাড়ায় যাত্রীরা মোটরসাইকেলে যাতায়াতের সুযোগ পাচ্ছেন। ফলে মোটরসাইকেলের ব্যবহার ও চাহিদা বেড়েছে।
এ অবস্থায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা হ্রাসে সর্বাগ্রে মোটরসাইকেলের জন্য আলাদা লেইন সম্বলিত সড়ক ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং ট্রাফিক আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা জরুরী। অন্যথায় মোটরসাইকেল সংক্রান্ত এসব আইনকানুন একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর পকেটই শুধু ভারী করবে, বিস্তৃত হবে চাঁদাবাজি। প্রস্তাবিত মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা-২০২৩ এ এসব বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। আমরা এদিকে সড়ক পরিবহন বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সমূহের দৃষ্টি ও মনোযোগ আকর্ষণ করছি।