আস্থা সংকটে ব্যবসা
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ মার্চ ২০২৩, ৪:৪৩:৫৯ অপরাহ্ন
ভারতের মাড়োয়ারি এবং পাকিস্তান আমলের বিহারী জুনাগড়ি ব্যবসায়ীদের কথা অনেকেরই মনে আছে। বর্তমান প্রজন্মের এসব জানার কথা নয়। উল্লেখিত ব্যবসায়ীদের ব্যবসার মূল পুঁজি ছিলো ক্রেতা- গ্রাহকদের আস্থা। আর সেই আস্থা তারা অর্জন করতেন অতি মুনাফা না করে, প্রতারণার আশ্রয় না নিয়ে। ফলে তাদের খ্যাতি ছিলো এই উপমহাদেশ জুড়ে। এখনো তার রেশ রয়ে গেছে। তারা কম লাভ করে বেশী পণ্য বিক্রির নীতি অবলম্বন করতেন। ক্রেতাদের কোনভাবেই ঠকাতেন না। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই আস্থা সংকট চরমে এদেশের বিভিন্ন ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে। এজন্য দায়ী অসৎ ব্যবসায়ী চক্র। গতকাল বিভিন্ন মিডিয়ায় ‘সংকটের আবর্তে পুঁজিবাজার’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, দেশের পুঁজিবাজার বর্তমানে এক সংকট সময় পার করছে। বর্তমানে বিনিয়োগকারীদের মাঝে যে আস্থার সংকট তৈরী হয়েছে, তা থেকে উত্তরণের চেষ্টা করতে হবে। তাদের সেই হারিয়ে যাওয়া আস্থা ফেরাতে হলে সুনির্দিষ্ট একটি পরিকল্পনা নিতে হবে।
কথা হচ্ছে, পুঁজিবাজারে একটি দেশের ব্যবসা বাণিজ্য ও অর্থনীতির প্রতিফলন ঘটে থাকে। এছাড়া পুঁজিবাজারের সাথে অগণিত বিনিয়োগকারীর আর্থিক কর্মকান্ড ও ভাগ্য জড়িত থাকে। যদি পুঁজিবাজার সুষ্ঠুভাবে চলে তবে লাখ লাখ মানুষ উপকৃত হয়, অসংখ্য বেকারের কর্মসংস্থান হয়। সর্বোপরি দেশের ব্যবসা বাণিজ্য ও অর্থনীতি সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়। কিন্তু কোন কারণে এই পুঁজিবাজার যদি আস্থা হারায় এবং বিনিয়োগকারীরা এই বাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তা পুনরুদ্ধার করা কিংবা পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা মুশকিল হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশের পুঁজিবাজার অর্থাৎ শেয়ার মার্কেটের বর্তমান অবস্থার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে কারসাজি। শেয়ার বাজারের অসৎ সিন্ডিকেট এই কারসাজির হোতা। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর উপর্যুপরি দুইবার শেয়ার বাজারে ধস নামে। এরপর বর্তমান সময় পর্যন্ত বহুবার শেয়ার বাজারে ধস নামতে দেখা গেছে। এসবের পেছনে ছিলো এই কারসাজিকারকেরা। এর ফলশ্রুতিতে লাখ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী পুঁজি হারান। কারসাজি করে শেয়ারের দাম কৃত্রিমভাবে অতিমাত্রায় বৃদ্ধি করে। বিনিয়োগকারীদের অর্থ পুঁজি কেড়ে নেয়ার নামই হচ্ছে শেয়ার বাজারের কারসাজি। বার বার এই কারসাজির সাথে ব্যক্তি ও কোম্পানীগুলোকে চিহ্নিত করা হলেও এদের বিরুদ্ধে তেমন কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অনেককে তো শাস্তি দেয়া দুরে থাক, তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করার মতো সাহস ও ক্ষমতা ছিলো না শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রক কিংবা এদেশের প্রশাসন বা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের। তৎকালীন অর্থমন্ত্রীকে প্রকাশ্যে এ বিষয়ে তার অপারগতার কথা প্রকাশ করতে দেখা গেছে। অনেক প্রভাবশালী কারসাজিকারককে মামলায় উচ্চ আদালত থেকে খালাস দেয়া হয়েছে। এর সবই ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ও সচেতন মহল লক্ষ্য করেছেন। পুঁজি হারিয়ে লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী সর্বস্বান্ত হলেও কোন বিচার বা প্রতিকার হয়নি। বহু সংসার ও সম্পর্ক ভেঙ্গে গেছে এই কারসাজির কারণে। অনেকে আত্মীয় স্বজনের নিকট থেকে ধারকর্জ করে কিংবা ব্যাংক থেকে ঋণ করে বিনিয়োগ করেছিলেন শেয়ারবাজারে। কিন্তু লাভ দূরে থাক, পুঁজিটুকুও ফিরিয়ে দিতে না পারায় তাদের জীবনে নেমে এসেছে বিপর্যয়। অনেকে আত্মহত্যা করে এই দুর্ভোগ থেকে বাঁচার চেষ্টা করেছেন।
গত এক যুগে শেয়ারবাজার নিয়ে এতো কারসাজি দুর্নীতির ঘটনা ঘটলেও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে ক্ষমতার শীর্ষ মহল পর্যন্ত কাউকে তেমন কোন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। বরং অনেক নেতামন্ত্রীকে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের উল্টো দোষারোপ করতে দেখা গেছে। এসবই শেয়ার বাজারে বিনিয়োগকারীদের শংকিত ও হতাশ করেছে। তাদের মাঝে দেখা দিয়েছে আস্থার সংকট। এ অবস্থায় শেয়ারবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন অনেকে। এতে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে শেয়ার বাজার। সৃষ্টি হয়েছে গভীর সংকট। বলা বাহুলা, শুধু শেয়ারবাজার নয়, সকল ব্যবসা বাণিজ্যেই ক্রেতা বা
গ্রাহকের আস্থা একটি প্রধান বিষয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, এদেশের বেশীর ভাগ ব্যবসায়ীই এই বিষয়ে খুব কমই গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এক সময়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র দুঃখ করে বলেছিলেন, বাঙালিরা ব্যবসা জানে না। তিনি ক্রেতা বা গ্রাহকের আস্থা সৃষ্টি বা ধরে রাখতে এদেশের ব্যবসায়ীদের ব্যর্থতা লক্ষ্য করেই তিনি একথাগুলো বলেছিলেন। তার এই বক্তব্যের সত্যতা ও যথার্থতা আজ আমরা হাঁড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। গত ক’বছরে চাল, পেঁয়াজ, তেল, আলু থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ পর্যন্ত বিভিন্ন পণ্য ও সেবা নিয়ে যে সিন্ডিকেটিং, কার্টেলিং এবং কারসাজি হয়েছে, তাতে এটাই সত্য হয়ে ওঠেছে। আমরা সৎ ব্যবসা চাই, কারসাজি নয়, এটা গ্রাহকের জন্য যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন ব্যবসায়ীদেরও। আশা করি সংশ্লিষ্ট সবাই এদিকে দৃষ্টি ও মনোযোগ দেবেন ।