ওয়ার্ল্ড র্যাংকিংয়ে উচ্চশিক্ষার দৈন্যদশা
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ মার্চ ২০২৩, ১২:৩৫:১৪ অপরাহ্ন
যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা সংস্থা কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডসের (কিউএস) বিশ্বসেরা ৮০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় স্থান পায়নি বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়। তবে গত বছরের মতো এবারও ৮০১ থেকে ১০০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রয়েছে বুয়েট ও ঢাবি। গত বুধবার এই কিউএস ওয়ার্ল্ড র্যাংকিং-২০২৩ প্রকাশ করা হয়। তবে এই র্যাংকিংয়ে সেরা ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ভারতের ৯টি এবং পাকিস্তানের ৩টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছে। এছাড়া ১০০১ থেকে ১২০০তম বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের আরো ২টি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়। সেগুলো হচ্ছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।
লক্ষণীয় যে, বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয় এমন ৫৪ টি বিষয়কে ৫ ক্যাটাগরী বা শ্রেণীতে ভাগ করে চলতি সপ্তাহে এই র্যাংকিং প্রকাশ করা হয়েছে। এ বছর মোট ১ হাজার ৫৯৪ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৫ হাজার ৭০০ টিরও বেশী একাডেমিক প্রোগ্রামের মর্যাদা ও গবেষণাকে বিবেচনায় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে র্যাংকিংয়ে স্থান দেয়া হয়েছে।
এবারের র্যাংকিংয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি ক্যাটাগরীতে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ৬৪ দশমিক ৪ স্কোর নিয়ে ৩৩৫ তম স্থানে রয়েছে। সোশ্যাল সায়েন্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট ক্যাটাগরীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অবস্থান ৪৫১-৫০০ এর মধ্যে। অন্যান্য ক্যাটাগরির মধ্যে আর্টস অ্যান্ড হিউম্যানিটিজ, লাইফ সায়েন্স অ্যান্ড মেডিসিন ও ন্যাচারাল সায়েন্সে এই ৩০ ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পায়নি।
বলা বাহুল্য, উপরোক্ত র্যাংকিংয়ের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষা খাতের যে দৈন্যদশা প্রকাশিত হয়েছে, এতে আমাদের মুখ লুকানোরও কোন জায়গা নেই, অজুহাত দেখানোরও কোন সুযোগ নেই। ক্ষমতাসীন মহল দেশের উন্নয়নের যে ঢামাঢোল বাজান কিংবা দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধি নিয়ে যে বাগাড়ম্বর করেন, এই র্যাংকিং এর গালে একটি বড় ধরনের চপেটাঘাত বলে মন্তব্য সচেতন মহলের। শিক্ষাকে যদি একটি দেশের মেরুদন্ড বলে গণ্য করা হয়, এবং উচ্চ শিক্ষাকে সেই মেরুদন্ডের উপরাংশ বলে বিবেচনা করা হয়, তবে বাংলাদেশের মেরুদন্ডটি উপরের দিকে সম্পূর্ণ বেঁকে গিয়ে গোটা দেশ মাথা নীচু করে মাটির দিকে ঝুঁকে পড়েছে বলেই ধরে নেয়া যায়। অর্থাৎ বাংলাদেশ নুব্জ পিঠের এক দুর্বল মানুষের উদাহরণ এখন। ক্ষমতাসীন মহল দীর্ঘদিন যাবৎ দাবি করে আসছেন বাংলাদেশ অনেক দিক দিয়ে ভারত ও পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে। যদি তা-ই হয়, তবে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাখাত বিশেষভাবে উচ্চশিক্ষা খাতের এমন হীন ও শোচনীয় দশা কেনো? এই খাতে উন্নয়নের কোন লক্ষণ নেই কেনো? এমন প্রশ্ন এখন যে কোন সচেতন মানুষের মনে জাগতে পারে।
বলা বাহুল্য, গত প্রায় এক যুগ ধরে এদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ বিশেষভাবে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দুর্নীতি, অনিয়ম ও নৈরাজ্যের ঘাঁটিতে পরিণত হতে দেখা যাচ্ছে। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কর্মকান্ড সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করার কথা সেসব বিভাগের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে দুর্নীতি ও নানা অনিয়মে জড়িত থাকতে দেখা যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদে আসীন ভাইস চ্যান্সেলরগণ অর্থাৎ ভিসিগণের বিরুদ্ধে গত ক’বছর ধরে দুর্নীতি ও আর্থিক অনিয়মের বিস্তর ঘটনা বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে এসবের প্রতিবাদ করতে গিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নামতে হয়েছে। ভিসির পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ ছাড়াও ভিসি’র রুমে তালা লাগাতে দেখা গেছে। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও একশ্রেণীর শিক্ষকই নয়, এ ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়মের সাথে যুক্ত হতে দেখা গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতাদেরও। ফলে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের চিরায়ত মূল্যবোধে ভাঙ্গন ও টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন বিশেষভাবে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের অনেক নেতাকর্মীর আচার আচরণ হয়ে ওঠেছে অছাত্রসুলভ এমনকি সন্ত্রাসধর্মী। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয় দেশের বেশীর ভাগ কলেজেও এমন অবস্থা লক্ষণীয়। এ অবস্থায় কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে পড়াশোনার মান কমে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা কার্যক্রম নেই বললেই চলে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বরাদ্দকৃত অর্থ শিক্ষা ও গবেষণা খাতে যথাযথভাবে ব্যয় হচ্ছে না। এছাড়া সরকার নানা কারণে যথেষ্ট অর্থও বরাদ্দ করছে না। এমনকি গোটা শিক্ষাখাতে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন, তা-ও দেয়া হচ্ছে না বাংলাদেশের বাজেটে।
এমন পরিস্থিতিতে নীচে নেমে গেছে দেশের উচ্চশিক্ষা বিশেষভাবে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের শিক্ষার মান। গত এক যুগে এ অবস্থার চরম অবনতি ঘটেছে। এর বহিঃপ্রকাশ ঘটছে কিউএস র্যাংকিংয়ে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সবচেয়ে বেশী দায়িত্ব সরকারের উর্ধ্বতন মহলের। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষাকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত রেখে এর মানোন্নয়নে এগিয়ে আসতে হবে সরকারকে। বাড়াতে হবে শিক্ষাখাতে বিশেষভাবে উচ্চশিক্ষাখাতে বরাদ্দ। আর তা করা গেলে দেশের উচ্চ শিক্ষা গতি পাবে, উর্ধ্বমুখী হবে র্যাংকিংয়ে।