ব্রয়লার মুরগী নিয়ে তেলেসমাতি!
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ মার্চ ২০২৩, ১২:৩০:৫২ অপরাহ্ন
ব্রয়লার মুরগী নিয়ে গত ক’দিন যাবৎ গোটা দেশের বাজার জুড়ে হৈ চৈ তোলপাড় চলছে। মাত্র কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে সম্প্রতি ব্রয়লার মুরগীর কেজি একশ থেকে দেড়শ টাকা বেড়ে যাওয়ায় দেশব্যাপী ক্রেতাদের মাঝে ক্ষোভ ও হতাশা দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত ভোক্তা অধিদপ্তর এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করলে ব্রয়লার মুরগীর দাম উর্ধমুখী থেকে নিম্নগামী হতে শুরু করেছে। চার বড় কোম্পানী দাম কমানোর পর ঢাকার বড় বাজারগুলোতে ব্রয়লার মুরগীর দাম এখন নেমে এসেছে ১৯৫ থেকে ২০০ টাকা কেজিতে।
উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কর্মকর্তাদের সাথে কয়েকটি পোল্ট্রি কোম্পানীর বৈঠকে চারটি কোম্পানী ব্রয়লার মুরগীর দাম কমানোর প্রতিশ্রুতি দেয়।
ব্রয়লার মুরগীর এ অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পেছনে ব্যবসায়ীরা মুরগীর বাচ্চা, খাদ্য এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানীর মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করলেও শুধু এসব উপাদানের মাধ্যমে ২ মাসে এই রেকর্ডমূল্য বৃদ্ধির সন্তোষজনক ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায়নি। সরকারী সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মুরগীর খাবারসহ অন্যান্য সব ব্যয় বাড়ার পরও এক কেজি ব্রয়লার মুরগীর উৎপাদন ব্যয় করপোরেট প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা। এই মুরগী ১৭০/১৮০ টাকা দরে বিক্রি করলেও কোম্পানীগুলোর ভালো লাভ থাকে। কিন্তু দেখা গেছে তারা একশ’/দেড়শ’ টাকা মুনাফা করেছে প্রতি কেজি মুরগীতে গত কয়েক সপ্তাহে। গত বৃহস্পতিবার জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কনফারেন্স হলে ব্রয়লার মুরগীর দাম নিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের এক বৈঠক হয়। বৈঠকে কোম্পানীগুলো ২৪ মার্চ থেকে ১৯০-১৯৫ টাকায় মুরগীর কেজি বিক্রি করবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। এর ফলে মুরগীর দাম কেজিতে কমেছে ৮৫ টাকা পর্যন্ত। আবার অনেক স্থানে এতোটা কমেনি বলে জানা গেছে। অনেক ব্যবসায়ী এখনো অতিরিক্ত দামে মুরগী বিক্রি করছেন। দিন দশেক আগে প্রকাশিত এক জরীপে দেখা গেছে, এক মাস আগে ব্রয়লার মুরগীর কেজি ছিলো ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা। তা বেড়ে দাঁড়ায় ২২৫ থেকে ২৩৫ এ।
গত ২৭ মার্চ বিভিন্ন মিডিয়ায় ‘ভারতের দ্বিগুন দামে ব্রয়লার মুরগী বিক্রি হচ্ছে বাংলাদেশে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে বেড়েই চলেছে মুরগীর দাম। বর্তমানে তা কেজিতে রেকর্ড ৩০০ ছুঁই ছুঁই। তবে প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ব্রয়লার মুরগীর দাম প্রায় ১৫০ টাকা। ভারতের ওয়েস্ট বেঙ্গল পোল্ট্রি ফেডারেশন এর তথ্যে বলা হয়েছে, গত দিনে কেজিতে ৪০/৫০ টাকা কমেছে পোল্ট্রি মুরগীর মাংস। বর্তমানে কোলকাতায় গোটা মুরগীর মাংস প্রতি কেজি ১৩০-১৩৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে হাওড়া, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনায় গোটা মুরগীর মাংস প্রতি কেজিতে ১২২-১২৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, বাজারে কেজি প্রতি আড়াইশ বা তার চেয়ে বেশী দরে বিক্রি হওয়া ব্রয়লার মুরগীর উৎপাদন খরচ তার অর্ধেকের কাছাকাছি। খামারীদের খরচ পড়ে কেজিতে; ১৫০ থেকে ১৬৭ টাকা, আর করপোরেট কোম্পানীর ক্ষেত্রে তা ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকা। পোল্ট্রি খাতে জড়িতদের অংশ গ্রহণে মতবিনিময় বৈঠকে প্রকাশ পেয়েছে যে, মুরগী উৎপাদনকারী কর্পোরেট, পাইকার আর খুচরো ব্যবসায়ী এই তিন পক্ষই মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা করেছে। আর এই বিষয়টি যাতে প্রকাশ না পায়, সেজন্য কোন পর্যায়েই কেউ কোন রশিদ দেয়নি।
খামারিদের অভিযোগ, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের কাছে জিম্মি ছোট খামারীরা। মুরগীর বাজার নিয়ন্ত্রণ করা হয় এসএমএস’র মাধ্যমে। এমন অভিযোগ খামারিদের সংগঠন পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের। জনৈক মুরগী ব্যবসায়ী জানান, তিনি পাইকারীতে কর্পোরেট ফার্ম কাজী ফার্ম থেকে ২০৭ টাকা কেজিতে মুরগী কিনে কাঁচাবাজারে আড়াইশ টাকা দরে বিক্রি করেন। ১৩০ টাকায় উৎপাদন করে ২০৭ টাকায় বিক্রি যৌক্তিক কি-না, এমন প্রশ্নের কোন জবাব দেননি উক্ত কর্পোরেট ফার্মের কর্মকর্তা।
বলা বাহুল্য, বাজারের সরবরাহ ও চাহিদার ওপর ভিত্তি করে সব সময় বাজার দর নির্ধারণ করতে গেলে কৃষি বিপণন আইনের ব্যত্যয় ঘটবে। তবে আইনে স্পষ্ট লেখা আছে, উৎপাদন ও খরচের পর কত লাভ করা যাবে। কিন্তু পোল্ট্রি ব্যবসায়ীদের এটা অনুসরণ করতে দেখা যাচ্ছে না। বরং সুযোগ বুঝে উৎপাদন কমিয়ে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে মুরগী বিক্রি করতে দেখা যাচ্ছে। এভাবে তারা শত শত কোটি লুটে নিচ্ছে। আর সাধারণ ক্রেতারা মুরগী কিনতে বাজারে এসে হতাশ হচ্ছেন।