জট খুলছে সাগর-রুনী হত্যাকান্ডের
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৩৫:১৫ অপরাহ্ন
বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে পেশাগত কারণে জীবনদানের অনেক নজীর রয়েছে। তবে এগুলোর মধ্যে নৃশংসতম হচ্ছে সাগর-রুনীর হত্যাকান্ড। অভিযোগ রয়েছে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ছত্রছায়ায় সংঘটিত এই হত্যাকান্ডের নেপথ্যে দেশের জ্বালানী ও বিদ্যুৎ খাতের লুটেরা মাফিয়ারা জড়িত। তাই দীর্ঘদিনেও সুরাহা হয়নি এই মামলার। তবে এই মামলার জট খুলতে শুরু করেছে এক যুগ পর ৫ আগস্টে স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের পতনের পর। এই মামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের পথে রাষ্ট্রীয় প্রতিবন্ধকতা অপসারিত হওয়ায় প্রকৃত অপরাধীদের পরিচয় সামনে আসার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। গত কিছুকালের সুষ্ঠু তদন্তে সাগর-রুনী হত্যাকান্ডের মূল হোতা হিসেবে দেশের জ্বালানী ও বিদ্যুৎ খাতের সবচেয়ে বড় লুটেরা মাফিয়া সামিট গ্রুপের লোকজনের নাম ওঠে এসেছে। অবশ্য তদন্ত এখনো অব্যাহত রয়েছে।
স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের আমলে সাংবাদিকতা জগতের এই চরম নৃশংস হত্যাকান্ড নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করতেও শংকিত ও দ্বিধান্বিত ছিলেন সাংবাদিকরা। বাধাগ্রস্ত ছিলো মিডিয়া। অনেক সাংবাদিক ও মিডিয়া অপশক্তি কুচক্রীদের হাতে হাত মিলিয়েছিলো। তা সত্বেও মাঝে মধ্যে কিছু মিডিয়া এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠাতো, প্রকাশ করতো সংবাদ প্রতিবেদন। এমনি একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় অনলাইন পত্রিকায় গত ২০২২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারী। এর শিরোনাম ছিলো ‘সাগর-রুনী হত্যা ঃ ২৪ ঘণ্টা শেষ হয়নি এক দশকেও’। প্রতিবেদনে বলা হয়, সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকান্ড ঘটেছিলো ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুযয়ারী। সেই থেকে এক দশক পেরিয়ে গেছে। কিন্তু তদন্তে অগ্রগতি নেই। মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় তদন্ত শেষ করার আশ্বাস দিয়েছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। তবে নয় বছর পেরিয়ে একাধিক সংস্থার হাত বদলেও দাখিল হয়নি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন। তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলে ইতোমধ্যে ৮৫ বার সময় নেয়া হয়েছে।
উপরোক্ত মিডিয়ার প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ২০২০ সালের ৩ মার্চ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হাইকোর্টে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন। পরে একই বছরের ২০ সেপ্টেম্বর ঢাকার চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্রায় একই রকম অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করেন। উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, সাগর-রুনী হত্যাকান্ডের ঘটনায় দু’জন অপরিচিত ব্যক্তি জড়িত ছিলো। সাগরের হাতে বাঁধা চাদর ও রুনির টি-শার্টে ওই দুই ব্যক্তির ডিএনএ’র প্রমাণ মিলেছে। অপরাধীদের শনাক্ত করতে ডিএনএ রিপোর্ট প্রস্তুতকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দু’টি ল্যাব কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বর্তমানে যোগাযোগ অব্যাহত আছে। প্রতিষ্ঠান দু’টি ডিএনএ’র মাধ্যমে অপরাধীর ছবি বা অবয়ব প্রস্তুতের প্রচেষ্টায় কাজ করে যাচ্ছে। এভাবে নানা অজুহাতে মামলাটির পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রদান করা হয়নি এতোদিন। এর পেছনে যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শীর্ষ ব্যক্তিদের হাত ছিলো এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। এবার সেই বাধা অপসারিত হওয়ায় বেরিয়ে আসছে প্রকৃত সত্য। দেশের জ্বালানী ও বিদ্যুৎ খাতে অবাধ লুটপাট চালাতেই যে এই হত্যাকান্ড এতে কোন সন্দেহ নেই সংশ্লিষ্ট মহলের। সংশ্লিষ্টদের মতে, সামিট গ্রুপের দুর্নীতি ও অপকর্মের তথ্য ও কাগজপত্র সাগর-রুনীর হাতে চলে আসায় এবং তারা এ নিয়ে বিস্তারিত রিপোর্ট প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়ার ফলেই সংঘটিত হয়েছে এদেশের মিডিয়ার ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম ও নৃশংস জোড়া সাংবাদিক হত্যাকান্ড। তাদের হত্যাকান্ডের মাধ্যমে খুনী লুটেরা গোষ্ঠী বিগত দেড় দশক ধরে এই খাতে লুটপাটের অবাধ সুযোগ লাভ করে। লুটে নেয় লক্ষ কোটি টাকা। তাদের মূল হোতা পরিণত হয় সিঙ্গাপুরের সেরা ধনী ব্যক্তিতে। ধ্বংস হয় দেশের অর্থনীতি।
সম্প্রতি শ্বেতপত্র প্রণয়নের দায়িত্বে নিয়োজিত বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ডঃ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, স্বৈরাচারী হাসিনার সরকার দেশের দু’টি কিডনীই নষ্ট করে ফেলেছে। তার মতে, কিডনী দু’টির একটি হচ্ছে ব্যাংকিং খাত আর অপরটি জ্বালানী ও বিদ্যুৎ খাত। তার বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট যে, বিগত আওয়ামী সরকার গত দেড় দশকে দেশের বিদ্যুৎ খাতকে কীভাবে লুটেপুটে খেয়ে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে নিয়ে এসেছে। আর সাগর-রুনী তাদের এই লুটপাটের পথে বাধা হয়ে দেখা দেয়ায় তারা তাকে খুন করতে মুহূর্তও বিলম্ব করেনি। তবে দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ন্যায়বিচারের বাধা অপসারিত হওয়ায় এবার মূল অপরাধীরা ধরা পড়বে এমন প্রত্যাশা সকলের। একটি চাপা দুঃখবোধ ও ক্ষোভ দূর হবে সাগর-রুনী হত্যাকান্ডে মর্মাহত প্রকৃত সাংবাদিক ও মিডিয়া কর্মীদের।