টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সিসিক ও লাফার্জহোলসিম এর অনন্য উদ্যোগ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ৬:৫৯:৪১ অপরাহ্ন
বাংলাদেশে টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ। দ্রুত নগরায়ন, শিল্পায়ন এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে দৈনন্দিন বর্জ্যরে পরিমাণ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। পরিবেশ দূষণ, জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি ও অপরিকল্পিত বর্জ্য ডাম্পিং রোধে কার্যকর, টেকসই ও বিজ্ঞানসম্মত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এখন জরুরী হয়ে পড়েছে। উন্নত দেশগুলো যখন এই বর্জ্যকে সম্পদে রুপান্তর করছে আমরা তখন সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে হিমশিম খাচ্ছি।
এশিয়া ইউরোপ ফাউন্ডেশন এর এক গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে প্রতি ১৫ বছরে এর শহুরে বর্জ্েযর পরিমান দ্বিগুন হচ্ছে। বাংলাদেশে ৯০ এর দশকে প্রতিদিন গড়ে ৬,৫০০ টন মিউনিসিপ্যাল সলিড ওয়েস্ট তৈরি হতো যা ২০১৯ সালের রিপোর্ট অনুসারে ২৫,০০০ টন ছাড়িয়ে গেছে। সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভাগুলোর জন্য এই বর্জ্য টেকসই উপায়ে ব্যবস্থাপনা কঠিন হয়ে দাড়িয়েছে।
এই যখন সামগ্রিক চিত্র তখন টেকসই উপায়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অনন্য এক উদাহরণ তৈরি করেছে সিলেট সিটি করপোরেশন। দেশের প্রথম এবং একমাত্র সিটি করপোরেশন হিসেবে বর্জ্েযর টেকসই ব্যবস্থাপনায় তারা সিলেটের লালমাটিয়া ডাম্পিং গ্রাউন্ডে ১৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে স্থাপন করেছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির একটি ম্যাটেরিয়াল রিকভারি ফ্যাসিলিটি। এই ফ্যাসিলিটি স্থাপনে এবং বর্জ্েযর টেকসই সমাধানে সিলেট সিটি করপোরেশন পাশে পেয়েছে লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশকে। একটি প্লাস্টিক ও পলিথিন মুক্ত শহর সিলেটবাসীকে উপহার দেয়ার লক্ষ্যে একসাথে কাজ করছে তাঁরা।
সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩৭৫ টন বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য তৈরি হয় যার একমাত্র ঠিকানা লালমাটিয়া ডাম্পিং গ্রাউন্ড। বাসা-বাড়ি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের এই বর্জ্যগুলো নির্দিষ্ট স্থান থেকে সংগ্রহ করেন সিটি করপোরেশন এর পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা। সংগ্রহের পর কিছু রিসাইক্লেবল পণ্য তারা আলাদা করেন এবং বিক্রি করেন। বাকী সকল অপচনশীল বর্জ্য নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে নিয়ে আসা হয় এই ডাম্পিং গ্রাউন্ডে যার আয়তন প্রায় ৮ একর যেখানে ডাম্প করা রয়েছে আনুমানিক ৮ লাখ টন বর্জ্য। এই বর্জ্েযর টেকসই সমাধানের জন্য দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করছিল সিলেট সিটি করপোরেশন এর কর্মকর্তাবৃন্দ।
সিলেট সিটি করপোরেশন এর চীফ ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট কর্মকর্তা মোহাম্মদ একলীম আবদীন এর সাথে কথা বলে জানা যায় অতীতে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে নানাবিধ উদ্যোগ নেয়া হলেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কার্যকরী কোন সমাধান আসেনি।
বাংলাদেশে একমাত্র লাফার্জহোলসিম এর ছাতক প্ল্যান্টে আমদানি বিকল্প পণ্য ক্লিংকার উৎপাদন হয়। ক্লিংকার তৈরির সুবিধা থাকায় এই প্ল্যান্টে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সুযোগ রয়েছে। এর সুবিধার নাম জিওসাইকেল।
বাংলাদেশে জিওসাইকেল এর সিনিয়র ম্যানেজার লতিফুর রহমান এর সাথে কথা বলে জানা গেছে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সিলেট সিটি করপোরেশন এর সাথে টেকসই উপায়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা হয়। এরপর শুরু হয় সিলেটে লালমাটিয়া ডাম্পিং গ্রাউন্ডে ম্যাটেরিয়াল রিকভারি ফ্যাসিলিটি বসানোর কাজ। ফ্যাসিলিটি বসানোর পর তা উদ্বোধন করা হয় ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এবং এখান থেকে বর্জ্য নেয়া শুরু হয় ২০২৪ সালের মে মাসের ১৪ তারিখে।
লতিফুর রহমান আরো জানান, প্রতিদিন গড়ে ৬০ টনেরও বেশি বর্জ্য এই ডাম্পিং গ্রাউন্ড থেকে ছাতকে লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ এর সিমেন্ট প্ল্যান্টে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং টেকসই উপায়ে ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে এর পরিমান বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে কোম্পানিটির। এই ডাম্পিং গ্রাউন্ড থেকে বিভিন্ন ধরনের অপচনশীল দ্রব্য বিশেষ করে প্লাস্টিক ও পলিথিন পৃথক করা হয় এই ম্যাটেরিয়াল রিকভারি ফ্যাসিলিটির মাধ্যমে। তারপর কোম্পানির নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় তা নিয়ে যাওয়া হয় সিমেন্ট প্ল্যান্টে।
এই ডাম্পিং গ্রাউন্ডের সকল বর্জ্য টেকসই উপায়ে ব্যবস্থাপনা করতে সাত থেকে আট বছর সময় লাগতে পারে বলে জানান তিনি।
সিমেন্ট প্ল্যান্টে এই বর্জ্যগুলো নিয়ে তা সিমেন্ট কিল্নে প্রেরনের উপযোগী করে তোলা হয়। এরপর তা বিশেষ একটি ফিডারের মাধ্যমে সিমেন্ট কিলনে প্রেরন করা হয়। এই কিলনে ক্লিংকার তৈরির জন্য প্রয়োজন ১৫০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা। এই তাপমাত্রায় সমস্ত বর্জ্য কো-প্রসেস হয়ে যায় যার কোন অবশিষ্ট পরিবেশে ফেরত আসে না। বর্তমানে জিওসাইকেল প্রযুক্তির মাধ্যমে বছরে প্রায় এক লাখ টন বর্জ্য টেকসই উপায়ে ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব। এর সক্ষমতা বাড়াতে ইতিমধ্যে পরিকল্পনা নিয়েছে কোম্পানিটি।
সিলেট সিটি করপোরেশন এর প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, “লাফার্জহোলসিম জিওসাইকেল প্রযুক্তির মাধ্যমে যে সেবা দিচ্ছে তা প্রশংসার দাবীদার। সিলেট সিটি করপোরেশন এর বর্জ্যবিহীন একটি সবুজ নগরী উপহার দেয়ার যে লক্ষ্য রয়েছে তা অর্জনে লাফার্জহোলসিম গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।”
লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ এর প্রধান নির্বাহি মোহাম্মদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, “লাফার্জহোলসিম সবসময়ই টেকসই উন্নয়নে বিশ্বাস করে। কোম্পানির টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সমাধান জিওসাইকেল পরিবেশ অধিদপ্তর অনুমোদিত এধরনের একমাত্র পদ্ধতি। এর মাধ্যমে আমরা দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সুবিধা দিয়ে আসছি। আমাদের লক্ষ্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি বর্জ্যবিহীন দেশ উপহার দেয়া।”
একই পদ্ধতিতে দেশের অন্যান্য সিটি করপোরেশনগুলোকে সহযোগিতা করতেও কোম্পানিটি আগ্রহী বলেন জানান তিনি।
সম্প্রতি নারায়নগঞ্জ সিটি করপোরেশন এর একটি প্রতিনিধি দল সিলেট সিটি করপোরেশন এর ম্যাটেরিয়াল রিকভারি ফ্যাসিলিটি ও ছাতকে লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশের সিমেন্ট প্ল্যান্টে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি ঘুরে দেখে সন্তুষ্টি প্রকাশ করার পাশাপাশি একসাথে কাজ করার ব্যপারে আশা প্রকাশ করেন।
সিলেট সিটি করপোরেশনে এই ম্যাটেরিয়াল রিকভারি ফ্যাসিলিটি স্থাপনে অগ্রনী ভূমিকা রেখেছেন তৎকালীন মেয়র জনাব আরিফুল ইসলাম। তিনি জানান, “অতীতে অনেক প্রতিষ্ঠানের সাথে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করলেও সফলতা আসেনি। লাফার্জহোলসিম এর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিটি বাস্তবসম্মত এবং এর মাধ্যমে উভয়েই লাভবান হচ্ছে। সিলেট সিটি করপোরেশন এর এই উদ্যোগ দেশের অন্যান্য সিটি করপোরেশনগুলোর জন্য উদাহরণ হতে পারে।” এই প্ল্যান্টের কার্যক্রম সচল রাখতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মনোযোগ আকর্ষণ করেন তিনি।
এশিয়া ইউরোপ ফাউন্ডেশন এর এক গবেষণা অনুযায়ী বাংলাদেশে যে পরিমান বর্জ্য প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে তার শতকরা ৫৫ ভাগ যেখানে সেখানে ফেলা হয়। আর যতটুকু সংগ্রহ করা হয় তার বড় একটা অংশ মাটিতে স্তুপ করে রাখা হয় কিংবা পুড়িয়ে ফেলা হয় যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকী। এর ঋনাত্মক ফলাফল আমরা ভোগ করছি প্রতিদিন, যার অন্যতম উদাহরন হতে পারে জলাবদ্ধতা। শহরগুলোর খাল, ডোবা এবং ড্রেইন দিয়ে পানি প্রবাহিত হতে পারে না, অল্প বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় রাস্তাঘাট। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রানের অন্যতম উপায় হলো সচেতনতা বৃদ্ধি এবং টেকসই উপায়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। বিজ্ঞপ্তি