সততা তিরস্কৃত দুর্নীতি পুরস্কৃত
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ মার্চ ২০২৩, ১২:১৫:০৩ অপরাহ্ন
জানা গেছে চাকুরী আর ফেরত পাচ্ছেন না দুর্নীতি দমন কমিশনের (কর্মচারী) বহুল আলোচিত সাবেক উপ-পরিচালক শরীফ উদ্দিন। কোন ধরণের কারণ দর্শানো ছাড়া কোন কর্মীকে চাকুরী থেকে অপসারণের বিধিটি বাতিল ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে সংস্থাটির করা আপীলের ওপর রায় ঘোষণা করেছে আপীল বিভাগ। গতকাল প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ৮ সদস্যের আপীল বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে বলা হয়, কোন কারণ দর্শানো ছাড়া দুদক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকুরীচ্যুত করা যাবে। দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) চাকুরী বিধিমালার ৫৪ (২) বিধি অনুসারে গত বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারী দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিনকে চাকুরী থেকে অপসারণ করা হয়। এরপর ৫৪ (২) বিধি ও এই বিধির ক্ষমতাবলে চাকুরীচ্যুতির বৈধতা নিয়ে শরীফ গত বছর হাইকোর্টে রীট করেন।
জানা গেছে, দীর্ঘ সময় চট্টগ্রামে কর্মরত ছিলেন শরীফ উদ্দীন। তিনি কক্সবাজারে ৭২ টি প্রকল্পে সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকার ভূমি অধিগ্রহণে দুর্নীতি, কিছু রোহিঙ্গার এনআইডি ও পাসপোর্ট জালিয়াতি, কর্ণফুলী গ্যাসে অনিয়মসহ বেশ কিছু দুর্নীতি বিরোধী অভিযান পরিচালনার পাশাপাশি মামলা করেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজরা। ফলশ্রুতিতে গত ২০২১ সালের ১৬ জুন তাকে চট্টগ্রাম থেকে বদলী করা হয়। এরপর তাকে ১৬ ফেব্রুয়ারী চাকুরীচ্যুত করা হয়। চাকুরীচ্যুতির কোন কারণ উল্লেখ করেনি কর্তৃপক্ষ। তিনি ২৭ ফেব্রুয়ারী ওই আদেশ প্রত্যাহারপূর্বক চাকুরীতে পুনর্বহালের আবেদন করেন। তবে তার আবেদন কমিশনের কাছে বিবেচিত হয়নি। পরে শরীফকে চাকুরীতে পুনর্বহাল চেয়ে এক আইনজীবী হাইকোর্টে রীট করেন।
বলা বাহুল্য, শরীফ উদ্দীনের ৭ বছরের চাকুরী জীবনে প্রথম ৬ বছরই বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে (এসিআর) দুদকের সিনিয়র কর্মকর্তারা তাকে ‘অতি উত্তম’ হিসেবে মূল্যায়ন করেন। তাকে তদন্ত কাজে অভিজ্ঞ এবং উদ্যমী ও দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে উল্লেখ করে দুদক। শরীফ উদ্দীন বলেন, আমি নিজের ইচ্ছায় কিছু করিনি। অনুসন্ধান, মামলা দায়ের ও তদন্ত উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে করেছি। যেসব দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দিয়েছি, তা দিয়েছি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে। তদন্তে যা পেয়েছি, তা-ই তুলে ধরেছি। দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে কখনো আপোস করিনি। আপোষ করলে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থের মালিক হতে পারতাম। তিনি বলেন, দুর্নীতিবাজরা বিভিন্ন সময়ে হুমকি দিয়ে বলেছিলো, কীভাবে চাকুরী করি দেখে নেবে। ফেসবুকে তাদের হুমকির স্ক্রীনশট রয়েছে। এ প্রসঙ্গে তখন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক বলেন, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কাজ করে শরীফ আজ চাকুরীচ্যুত, পুরস্কার পাওয়ার জায়গায় তিরস্কৃত হয়েছেন। এতে দুর্নীতিবাজরা উৎসাহিত হচ্ছে। যার কারণে দুর্নীতি না কমে বাড়তে থাকবে। চাকুরীচ্যুত দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দীন তার তদন্তে ১৯ জন প্রভাবশালী আমলার সম্পৃক্ততা পান। তাদের মধ্যে কক্সবাজারের সাবেক জেলা প্রশাসক, তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব), অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (উন্নয়ন ও মানবসম্পদ) অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইটি), ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সহকারী কমিশনার (ভূমি), কক্সবাজার সদর, পিআইবি পুলিশ সুপার ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অন্তর্ভুক্ত। তাদের অনেকে এখন পদোন্নতি পেয়ে মন্ত্রণালয়ে আছেন। আছেন গুরুত্বপূর্ণ জেলায়। বলা বাহুল্য, দুর্নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে শীর্ষে আর এদেশের দুর্নীতিবাজদের মধ্যে সরকারী আমলাদের অবস্থানও তালিকার উপরের দিকে। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন এবং সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা তাদের দায়িত্ব হলেও এর উল্টোটি দেখা যাচ্ছে তাদের কর্মকা-ে। দুর্নীতি দমনের পরিবর্তে তাদের অনেকে নিজেরাই আকণ্ঠ নিমজ্জিত দুর্নীতিতে। আর তাদের এই দুর্নীতির প্রতিবাদ করতে গিয়ে সৎ দুদক কর্মকর্তাকে শেষ পর্যন্ত হারাতে হয়েছে চাকুরী। আর দুর্নীতিবাজরা পুরস্কৃত হয়ে আজ প্রশাসনের শীর্ষ পদগুলোতে সমাসীন। এই হলো বাংলাদেশের প্রশাসনের বর্তমান চিত্র, হালচাল। কিন্তু সৎ দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দীন চৌধুরী চাকুরী হারালেও এদেশের এমনকি বিশ্বের সকল বিবেকবান মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা থেকে যে কখনো হারিয়ে যাবে না, একথা নির্দ্ধিধায় বলা যায়। আর দুর্নীতিবাজ প্রভাবশালীরা সাময়িকভাবে পুরস্কৃত হলেও তারা চিরদিন সচেতন বিবেকবান মানুষের ঘৃণাই কুড়াবে, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।