আয়-ব্যয়ে আকাশ-পাতাল তফাৎ
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ এপ্রিল ২০২৩, ১২:৩৫:০৩ অপরাহ্ন
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৬ বছরে গৃহস্থালীর অর্থাৎ পরিবার প্রতি খরচ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এর পরিমাণ ৩১ হাজার ৫০০ টাকা। জরীপটি ২০২২ সালের। বিগত ২০১৬ সালে যখন ‘গৃহস্থালীর আয় ও ব্যয়’ (এইচআইইএস) শীর্ষক জরীপটি করা হয় তখন দেশে পরিবার প্রতি ব্যয় ছিলো ১৫ হাজার ৭১৫ টাকা। ২০২২-এর জরীপে ৩১ জানুয়ারী, ২০২২ থেকে শুরু হয়ে ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ সময়ে অর্থাৎ এক বছর ধরে তথ্য সংগ্রহ করে পরিসংখ্যান ব্যুরো।
উপরের পরিসংখ্যানটি রীতিমতো উদ্বেগজনক। সরকারী হিসাবেই যদি গৃহস্থালীর ব্যয় এতো বেশী হয়ে থাকে, তবে প্রকৃতপক্ষে এর পরিমাণ কতোটুকু তা ভাবতেও শংকা হওয়ার কথা। সাধারণতঃ সরকারী পরিসংখ্যানে অর্থনীতির ভালো দিকটি খারাপ দিকের চেয়ে বেশী মাত্রায় উপস্থাপন করা হয়। যেমন জিডিপি কিংবা পার ক্যাপিটা ইনকাম অর্থাৎ মাথাপিছু আয়ের কথা বলা যায়। একথা ভাবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, গত ৬ বছরে গৃহস্থালীর ব্যয় দ্বিগুণেরও বেশী বেড়েছে। অনেক পণ্য ও সেবার মূল্যের দিকে দৃষ্টিপাত করলে তা সহজেই ধারণা করা যায়।
কথা হচ্ছে, সরকারী হিসাব অনুযায়ী গত অর্ধযুগে গৃহস্থালীর ব্যয় যদি দ্বিগুণ হয়ে থাকে, তবে এ সময়ে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আয় কি এমনভাবে বেড়েছে? এ প্রশ্ন যে কোন মানুষ করতে পারে। যদি বেড়ে না থাকে, তবে নিশ্চিতভাবেই এদেশের জনগণের জীবনযাত্রার মান হ্রাস পেয়েছে। তাহলে উন্নয়নের এতো দাবি ও বাগাড়ম্বর কিসের জন্য? গত ৬ বছর ধরে জনগণের দুর্ভোগ যখন বাড়ছে, তখন ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে যে, দেশ উন্নতির মহাসড়ক ধরে এগিয়ে যাচ্ছে, উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে ইত্যাদি।
দেশের গৃহস্থালীসমূহ তথা সাধারণ মানুষের আর্থিক দুর্দশা ও মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট ও মন্দাকে অনেকটা দায়ী করা যায়। কিন্তু মূলতঃ রুশ-ইউক্রেইন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট এই আর্থিক সংকট শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্বের সকল দেশকেই কম বেশী ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। যেসব দেশ এই যুদ্ধের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত সে সব দেশে এই যুদ্ধের প্রভাব সবচেয়ে বেশী পড়ার কথা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ কোনভাবেই জড়িত না থাকা সত্বেও রুশ-ইউক্রেইন যুদ্ধ শুরু পর থেকে চরম আর্থিক সংকটের মধ্যে দিন অতিবাহিত করছে। তেলের সংকটের কথা বলে দেশে তেলের দাম প্রায় ৪৭ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়। এর ফলে বেড়ে যায় পণ্য ও সেবার দাম। ডলার সংকট চরম আকার ধারণ করে। গত এক বছরে মূল্যস্ফীতি ও ডলার সংকট বিশ্বের প্রতিটি দেশে লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এই সংকট যে হারে দেখা গেছে বা এখনো যাচ্ছে, প্রতিবেশী শ্রীলংকা ও পাকিস্তান ছাড়া আর কোন দেশেই এমনটি দেখা যায়নি। উন্নত দেশগুলোতো দ্রুতই এই সংকট কাটিয়ে এখন বেশ ভালো অবস্থানে চলে এসেছে। তেমন হাহাকার নেই কোন দেশেই।
গত কয়েক মাসে বিশ্ববাজারে তেল ও খাদ্যপণ্যের দাম অনেক কমেছে। কিন্তু এর কোন ইতিবাচক প্রভাব নেই বাংলাদেশে। বরং অনেক সেবা বিশেষভাবে বিদ্যুতের দাম প্রায় প্রতি মাসে বাড়ানো হচ্ছে। এটা করা হচ্ছে তেলের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে। অথচ তেলের দাম এখন রেকর্ড পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। তেলের দাম কমলেও বিদ্যুতের দাম কমা দূরে থাক, বরং দফায় দফায় বাড়ছে। এছাড়া গত ক’মাসে বিশ্ব বাজারে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দাম অনেক কমেছে। কিন্তু এর কোন ইতিবাচক প্রভাব নেই বাংলাদেশে। বাংলাদেশে চাল, ডাল, তেল, আটা চিনি এসব নিত্যপণ্যের দাম উর্ধমুখী।
এ অবস্থায় প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো দেশের গৃহস্থালী তথা জনগণের আয় ব্যয়ের এই চরম বাস্তবতাটুকু যখন প্রকাশ করছে, তখন ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীকে এ নিয়ে কোন অনুশোচনা কিংবা দুঃখ প্রকাশ করতে দেখা যাচ্ছে না। একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর উপস্থিতিতেই পরিসংখ্যান ব্যুরো এই তথ্য প্রকাশ করেছে। কিন্তু এজন্য মন্ত্রীর মাঝে বিকার নেই, তিনি নির্বিকার, ভাবলেশহীন। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। উন্নয়নের কথা শতমুখে প্রচার করলেও মানুষের এই দুর্ভোগের জন্য, তাদেরকে বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত হতে দেখা যাচ্ছে না। যদিও এই দুর্ভোগের জন্য তারাই দায়ী। তাদের দুর্নীতি অর্থ পাচার সিন্ডিকেটিং দেশের অর্থনীতির এই দুরবস্থার জন্য মূলত: তারাই দায়ী। যখন ব্যয় বৃদ্ধি হয়েছে দ্বিগুণ, তখন সাধারণ মানুষের আয় বৃদ্ধি বা কর্মসংস্থানের জন্য কোন কার্যকর পদক্ষেপ বা উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না তাদের।