সুশাসনের নজীর আফগানিস্তান
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ এপ্রিল ২০২৩, ৯:৫৬:৫৮ অপরাহ্ন
সম্প্রতি আফগান অর্থনীতিসহ সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। এতে স্বল্প সময়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশটির এক অভাবনীয় সাফল্যের চিত্র ফুটে ওঠেছে। ‘আফগান ইকোনোমিক মনিটর’ শীর্ষক এই আর্থ-সামাজিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাস থেকেই উল্লেখযোগ্য সব বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে আফগান মুদ্রা শক্তিশালী হয়েছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারী থেকে ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত রাজস্ব আদায় হয়েছে ১৩৩.৯ বিলিয়ন আফগান মুদ্রা। এর বেশীর ভাগ অর্থাৎ ৫৫ ভাগ এসেছে বর্ডার ট্যাক্স (কাস্টমস্) বাবদ। বাকী ৫৫ শতাংশ এসেছে অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক ফী বাবদ। রফতানী বাণিজ্যে এক মাইলফলক ছুঁতে যাচ্ছে দেশটি। দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে রফতানীর হার। প্রায় ৬০ ভাগ পণ্য রফতানী হয় পাকিস্তানে। ভারতে রফতানী হয় ২৪ ভাগ। স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক উন্নতি করে চলেছে আফগান সরকার। সরকারী চাকুরীজীবীরা নির্দিষ্ট সময়ে কোন ধরনের হয়রানি ছাড়াই তাদের বেতন পাচ্ছেন। পুরো দেশজুড়ে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের রিজার্ভ অত্যন্ত শক্তিশালী। কোন পণ্যের জন্য হাহাকার নেই। মুদ্রাস্ফীতি অনেক কমে এসেছে। ২০২২ সালের জুলাই মাসে মুদ্রাস্ফীতির হার ছিলো ১৮.৩ শতাংশ, তা ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারীতে নেমে আসে ৩.৫ শতাংশে। বর্তমানে আরো কমেছে মুদ্রাস্ফীতি। আফগান সরকার পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। আফগানিস্তানের তালেবান সরকার তার খনিজ সম্পদের যথাযথ আহরণ ও এগুলো থেকে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে সচেষ্ট।
জানা গেছে, চীনের কোম্পানী গোচিন দেশটির লিথিয়াম মজুত উন্নয়নে এক হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। খনিজ ও পেট্রোলিয়াম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত আফগান মন্ত্রী শাহাবুদ্দীন দেলাওয়ার জানিয়েছেন, লিথিয়াম খনিতে বিনিয়োগ হলে ১ লাখ ২০ হাজার লোকের প্রত্যক্ষ এবং ১০ লাখ লোকের পরোক্ষ কর্মসংস্থান হবে। গোচিন প্রস্তাব দিয়েছে যে, লিথিয়াম আফগানিস্তানের ভেতরেই প্রক্রিয়াজাত করা হবে। এই কাজের জন্য একটি পানিবিদ্যুৎ বাঁধ তৈরী এবং কুমার ও লাগমান সড়কে পিচ ঢালাই করা হবে। আফগানিস্তানে ১ লাখ কোটি ডলারের লিথিয়াম মজুত আছে বলে ধারণা।
বলা বাহুল্য, লিথিয়াম মোবাইলের ব্যাটারীসহ বিভিন্ন ব্যাটারীতে ব্যবহৃত হয়। লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারীর যুগ শুরু হওয়ায় শিল্পে যুগান্তকারী পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। বর্তমানে অধিকাংশ ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি শক্তি পাচ্ছে এই লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারী থেকেই। কিছুদিনের মধ্যে সব ইলেক্ট্রনিক যন্ত্র চালিত হবে লিথিয়াম দিয়ে। এর প্রভাব হবে সুদূর প্রসারী। শতবর্ষ আগে মধ্যপ্রাচ্যে জীবাশ্ম তেলের বিশাল ভান্ডার আবিস্কারের পর ভূরাজনীতি বা বিশ্বব্যবস্থায় যে বড় পরিবর্তন এসেছিলো, লিথিয়াম এখন তেমনি কিছু করতে যাচ্ছে। তাই লিথিয়ামকে এ শতাব্দির স্বর্ণ বললেও অতিরিক্ত বলা হবে না। গবেষক জিল মারি টারাসকনের মতে, আসলে লিথিয়াম সোনার চেয়েও দামি।
উপরোক্ত তথ্যাদি থেকে বুঝা যাচ্ছে লিথিয়াম আহরনে আফগান সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা সফল হলে আফগানিস্তানের অর্থনীতি আমূল বদলে যাবে। যেভাবে মধ্যপ্রাচ্যের সৌদী আরবসহ বিভিন্ন তেল গ্যাস সমৃদ্ধ দেশ বদলে গিয়েছিলো তেলের সুবাদে কয়েক যুগ আগে। সবচেয়ে বড় কথা, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ইতোমধ্যে অনেকের মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে। শুধুমাত্র সুশাসনের ফলে তারা বিধ্বস্ত অর্থনীতিতে ইতোমধ্যে শৃংখলা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে, যা বর্তমান সময়ে তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের জন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কিছুদিন আগে যে দেশের জনগণ অর্ধাহার অনাহারে ছিলো, ছিলো দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে সে দেশ এখন অভাবনীয় অর্থনৈতিক শৃংখলা ও উন্নতির পথে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। এখন দেশটিতে খাদ্য ও অন্যান্য পণ্যের জন্য কোন হাহাকার নেই, নেই আকাশচুম্বী মূল্যস্ফীতি। প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে বাণিজ্য ঘাটতিও আকাশপাতাল নয়। আর এর পেছনে তালেবান সরকারের তথা তালেবান নেতৃত্বের সততা, সুশাসন ও দেশপ্রেমই যে মূল নিয়ামক, এতে কোন সন্দেহ নেই। যে দেশটি এখনো বিশ্বের সব ক’টি বৃহৎ দেশসহ অধিকাংশ দেশ ও সংঘ-সংস্থার স্বীকৃতি পায়নি এবং বিদেশী সাহায্য সহযোগিতা থেকে প্রায় বঞ্চিত, সে দেশের বর্তমান অগ্রগতি দেখে বিশ্বব্যাংকও বিস্মিত। তালেবানদের ক্ষমতা গ্রহণের সময় অনেকে মন্তব্য করেছিলেন, তালেবানরা ক্ষমতায় এলে দেশটির জনগণ নিজেদের মধ্যে হানাহানি করে ধ্বংস হয়ে যাবে। অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটবে। কিন্তু কিছু কিছু ধর্মীয় ক্ষেত্রে কিছু গোঁড়ামী ও বাড়াবাড়ি সত্বেও সৎ ও দক্ষ তালেবান নেতৃত্ব তাদের মুখে চুনকালি মেখে দিয়েছে সততা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে।